সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র, টেলিভিশন এবং বিশেষত বিভিন্ন ওয়েবসাইট অগণিত সত্য-মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্যে ভরা।নভেল করোনাভাইরাস ও তার প্রতিরোধের ব্যবস্থা সম্পর্কে অনিশ্চয়তার ব্যাপারটি স্পষ্ট। মানবসভ্যতার ইতিহাস বলে, এ শত্রুরও মোকাবেলা করবে মানবজাতি আগে বা পরে। তবে সংকট-পরবর্তী অর্থনৈতিক ও আর্থিক মন্দা যে আরেকটি যুদ্ধের হাতছানি, তা বিশ্লেষকরা নিঃসংকোচে মেনে নিচ্ছেন। রাষ্ট্রীয় ও শিল্প পর্যায়ে তার মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে। কম উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য করোনা-পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতি মোকাবেলা পূর্ববর্তী সব অর্থনৈতিক ও আর্থিক মন্দাকে হার মানাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অর্থনৈতিক ও আর্থিক সমস্যা এবং মন্দা সরাসরি সম্পর্কিত। অর্থনৈতিক মন্দা আর্থিক খাতে বিশাল নেতিবাচক সমস্যার জন্ম দেয়, আবার আর্থিক মন্দা অর্থনৈতিক মন্দায় রূপান্তরিত হয়। পূর্ববর্তী সব মন্দা পরিস্থিতি এবং সর্বশেষ আর্থিক ও অর্থনৈতিক মন্দা (২০০৭-২০) আমাদের এ ধারণাকে বারবার প্রমাণ করেছে। করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনৈতিক ও আর্থিক মন্দা এরই মধ্যে সর্বশেষ বিশ্বমন্দার ভয়াবহতাকে অতিক্রম করেছে, এমন আভাস স্পষ্ট। সামনের সময়গুলোয় এর ফলাফল তীব্রভাবে বিশ্ব অর্থনীতিকে নাড়া দিচ্ছে ও দেবে, যা আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে। করোনা প্রতিরোধে কাজ করার পাশাপাশি করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক ও ব্যাংকিং খাতকে রক্ষায় প্রস্তুতির সময় এখনই।
সর্বশেষ বিশ্বমন্দা পরিস্থিতিতে ২০০৮-০৯ সালে প্রায় এক কোটি মানুষ চাকরি হারিয়েছিল। উন্নত ও বেশকিছু উন্নয়নশীল অর্থনীতি ও আর্থিক খাত হোঁচট খেয়েছিল। বেকারত্ব সমস্যা বিশ্ব অর্থনীতিকে গ্রাস করেছিল এবং পূর্ববতী সব মন্দাকে হার মানিয়ে বিশ্ববাণিজ্য সংকুচিত হয়েছিল। এরপর অবশ্য ২০১০-পরবর্তী সময় বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়। অবশ্যই করোনা-পরবর্তী অর্থনৈতিক ও আর্থিক মন্দা পরিস্থিতিকে পরিমাপ করার জন্য যথাযথ সময় আসেনি বা পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে সেটা সুস্পষ্ট নয়। তবে বিশ্বমানবতাকে যে একটি বড় ধরনের অর্থনৈতিক ও আর্থিক বিপর্যয়ের মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে তার যথেষ্ট আভাস রয়েছে।
করোনার প্রভাবে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়েছে। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে উদ্যোক্তা ও কর্মজীবী মানুষ কর্মক্ষেত্র থেকে অন্তত শারীরিকভাবে দূরে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ক্রমবর্ধমান হারে কর্মজীবী মানুষ চাকরি বা জীবিকা হারাচ্ছে। কর্মসংস্থানমুখী শিল্প, যেমন পর্যটনসহ বেশকিছু শ্রমঘন শিল্পের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বড় অংশের মানুষের আয়ের উৎস হুমকির মুখোমুখি হয়েছে। উন্নত বিশ্ব হয়তোবা এ পরিস্থিতিতে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বিনাশ্রমে নাগরিকদের খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী সরবরাহ করতে পারবে। তবে পরিস্থিতি দীর্ঘতর হলে কম উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জন্যও তা বড় বিপর্যয় ডেকে আনবে। আর অর্থনৈতিক ও বিশ্ববাণিজ্য বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়াবে আর্থিক ও ব্যাংকিং খাত। বিশ্ব অর্থনীতিতে শেয়ারবাজারগুলোর দরপতন ও ধস এরই মধ্যে মিডিয়া জগতের একটি বড় খবর। ব্যাংকিং খাত এরই মধ্যে অন্যান্য শিল্পের ন্যায় কর্মক্ষেত্রে বাধার মুখোমুখি হয়েছে। স্বাভাবিক ব্যাংকিং কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে মারাত্মকভাবে। পর্যায়ক্রমে ব্যাংকিং খাতের জন্য বিনিয়োগের ক্ষেত্র সংকুচিত হবে এবং বিনিয়োগকৃত বা ঋণের অর্থ সময়মতো ফেরত পাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিশ্ববাণিজ্য সংকোচন ও বিপর্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে এ-সংক্রান্ত অর্থায়ন পরিস্থিতিও ঝুঁকির মুখে পড়বে। আর্থিক মন্দা মোকাবেলায় উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত অর্থসংস্থানের জন্য কাজ করতে শুরু করেছে। এর পূর্ববর্তী মন্দার সময়গুলোয়ও কম সুদে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহের মাধ্যমে অথনৈতিক কর্মকাণ্ডকে চাঙ্গা রাখার কৌশল গ্রহণ করা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় ব্যাংক এরই মধ্যে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের ‘ডিসকাউন্ট উইন্ডো’ ব্যবহার করে ঋণ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার প্রচেষ্টা গ্রহণ করেছে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাদের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য কম সুদে ঋণ সরবরাহ করছে বিশেষত ক্ষুদ্র ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোয় ঋণ সুবিধা অব্যাহত রাখার জন্য। যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থনীতিতে পর্যাপ্ত অর্থ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য সুদের হার কম করেছে।পরিবর্তিত এ পরিস্থিতিতে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা ও কার্যক্রম বেছে নিচ্ছে।তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং বা ডিজিটাল লেনদেন এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। তবে সাধারণভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যের সংকোচনের কারণে যেকোনো ধরনের আর্থিক সেবার (মোবাইল ও অন্যান্য তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিংসহ) ওপর প্রভাব পড়েছে। বিভিন্ন দেশের ব্যাংকগুলো এরই মধ্যে মন্দ ঋণের প্রভাব অনুভব করতে শুরু করেছে, যেহেতু ঋণগ্রহণকারীরা সময়মতো ঋণের অর্থ ফেরত দিতে পারছেন না। বিশেষত ছোট ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলো এরই মধ্যে বেশ ক্ষতির মুখে পড়েছে। সুদের হার কম করার ফলে অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক কম সুদে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে অর্থ সরবরাহ করছে। অন্যদিকে অনিশ্চয়তার কারণে একটি বড় অংশের আমানত ব্যাংকগুলো থেকে উত্তোলন করছেন সাধারণ আমানতকারীরা।
বাংলাদেশ একটি ব্যাংকভিত্তিক অর্থনৈতিক খাত। ব্যাংকিং খাত বিপর্যস্ত হলে অর্থনীতির জন্য করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে উঠে দাঁড়ানো অত্যন্ত কঠিন হবে। উন্নত দেশগুলোর মতো নয়, বরং বাংলাদেশের বেসরকারি পর্যায়ের বিনিয়োগ সম্পূর্ণরূপে ব্যাংকিং খাতের ওপর নির্ভরশীল। সরকারি খাতও ব্যাংকিং খাতকে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ঋণের উৎস হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। সারা পৃথিবীতে শেয়ারবাজারের ধস আর্থিক খাত বিপর্যয়ের প্রাথমিক সংকেত। বাংলাদেশের ছোট আকারের আর্থিক বাজার এবং এর দরপতনের প্রভাব অর্থনীতির জন্য ভয়াবহ মনে না হলেও সার্বিক পরিস্থিতি মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকিং খাতে এ ধরনের অর্থনৈতিক মন্দা ও বিপর্যয়ের প্রভাব একটু দেরিতে প্রকাশিত ও প্রতিফলিত হয়। সুতরাং বিশ্ব ও বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের জন্য এ পরিস্থিতি শুধু শুরুর ধাক্কা। করোনা পরিস্থিতির সমূহ ভয়াবহতা ব্যাংকিং খাতকে বড় ধরনের বিপর্যয় মোকাবেলা করাতে বাধ্য করতে পারে। শঙ্কা আর অনিশ্চয়তার মাঝে প্রচেষ্টা আর প্রস্তুতি আশার বাণী শোনাচ্ছে।
বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ করোনা মোকাবেলায় কার্যক্রম শুরু করেছে। নতুন একটি সার্কুলারের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগামী জুন পর্যন্ত বিদ্যমান ঋণ শ্রেণীবিন্যাসকে অনুসরণ করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশনা দিয়েছে। এ নির্দেশনার সুফল দেশের ঋণগ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান/ব্যক্তি এবং ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান দুই পক্ষই পাবে। অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের ফলে ঋণগ্রহণকারীরা ঋণ পরিশোধের সময় পাচ্ছেন, অন্যদিকে ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপিসংক্রান্ত দায় এবং সংশ্লিষ্ট অতিরিক্ত জমার দায় থেকে এ সময়ের জন্য পরিত্রাণ পাবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত আমদানি ও রফতানিকারকদের জন্য বেশকিছু নিয়মের শিথিলতা ও সুবিধা প্রদান করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। যেমন রফতানির অর্থ পাওয়া; আমদানি বিল ও এন্ট্রি জমা করা; ব্যাক টু ব্যাক এলসি এবং রফতানি উন্নয়নসংক্রান্ত ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছে, যা ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০২০ পর্যন্ত বলবৎ থাকার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। পরিস্থিতি অনুযায়ী আমরা হয়তো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরো প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ দেখতে পাব।
ঋণঝুঁকি মোকাবেলাসংক্রান্ত পরিস্থিতিতে সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো বেশ নাজুক সময় অতিবাহিত করছে।এ খাত সংশোধন ও পরিবর্ধন প্রচেষ্টার মাঝেই করোনা পরিস্থিতি নীতিনির্ধারকদের অর্থনৈতিক ও আর্থিক খাত থেকে করোনা প্রতিরোধে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে বাধ্য করছে। এ কথা বলা যায় যে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকেও করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতিতে কঠিন পরীক্ষার মুখোমুখি দাঁড়াতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ব্যাংকিং খাতের সংশ্লিষ্টতা উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়, যেখানে দেশের আর্থিক খাত বলতে মূলত ব্যাংকিং খাতকে বোঝানো হয়। এ পরিস্থিতিতে সংবেদনশীল এ খাতটিকে আগলে রেখে করোনা-পরবর্তী পরিস্থিতি সামলে উঠবে বাংলাদেশের অর্থনীতি, এমনটাই কাম্য।
আজকের বিশ্ব মহামারী ১৭৯৮ সালের ম্যালথাসের বিখ্যাত জনসংখ্যা তত্ত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়। থমাস ম্যালথাস সেখানে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রাকৃতিক পন্থার কথা উল্লেখ করেন, যার কারণ হিসেবে খাদ্যের চাহিদা ও সরবরাহের ব্যবধানের কথা বলা হয়েছিল। হয়তো তার তত্ত্ব এ পরিস্থিতির সঙ্গে হুবহু সংগতিপূর্ণ নয়, অর্থাৎ খাদ্যের চাহিদা ও জোগানের ব্যবধান নেই। তবে স্বাস্থ্যসম্মত ও পুষ্টিকর খাদ্যের চাহিদা ও জোগানের ব্যবধান প্রবল। এছাড়া মানবজাতির উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং লোভের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ সম্পদের ব্যবধান স্পষ্ট, যা মানবজাতিকে প্রকৃতিবিরুদ্ধ আচরণে উৎসাহিত করেছে। পরিবেশ ও প্রকৃতি এরই মধ্যে সমূহ বিপর্যয়ের ভবিষ্যৎ লিখতে শুরু করেছে (Malthusian Catastrophe)। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়, পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সম্পদের মোহ ও লোভ সংবরণের এক কঠিন শিক্ষা দিতে চলেছে আজকের এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলার অনেক সফলতার কাহিনী রয়েছে। করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করে মানবসভ্যতা সেখানে আরেকটি পালক যুক্ত করবে—এটাই কাম্য।