বিআইবিএম-এর আঞ্চলিক ব্যাংকিং সম্মেলন ২০১৮ ঃ ব্যাংকের মানব সম্পদ উন্নয়ন, ঝুকি ব্যাবস্থাপনা ও আর্থিক অর্ন্তভুক্তি

April 28, 2020
2114
Views

বিআইবিএম-এর আঞ্চলিক ব্যাংকিং সম্মেলন ২০১৮ ঃ ব্যাংকের মানব সম্পদ উন্নয়ন, ঝুকি ব্যাবস্থাপনা ও আর্থিক অর্ন্তভুক্তি
(বণিক বার্তায় ২০১৮ সালে প্রকাশিত)

                                                                                            -ড. শাহ্ মোঃ আহসান হাবীব

বর্তমান ও আগামী দিনের ব্যাংকিং খাতের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় মানব সম্পদ উন্নয়ন ও যোগ্য নেতৃত্ব তৈরীর বিকল্প নেই। একটি প্রতিষ্ঠান পরিচালনায় অবশ্যই সমস্যা বাঁধা, উত্থান-পতন এবং মন্দা আসবে। এ সময়কালই একটি নেতৃত্বের যোগ্যতার পরীক্ষার সময়। কার্যকরী নেতৃত্ব ও দক্ষ মানব সম্পদ এহেন পরিস্থিতিতে প্রতিষ্ঠানকে সচল রেখে লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সহায়তা করে। বিশ্বমন্দা পরিস্থিতি, মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত সচেতনতা বৃদ্ধি এবং কর্পোরেট খাতে বেশ কিছু কেলেঙ্কারী ব্যাংকের মানব সম্পদ উন্নয়নে নতুন সমস্যা এবং ঝুঁকির অবতারণা করেছে। এর বেশীর ভাগই ব্যাংকিং খাতের পরিবর্তিত বিধিমালা, বিশ্ব বাণিজ্য পরিস্থিতির সাথে খাপে খাওয়ানো ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা নীতিনির্ধারণী প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তিত বিধিমালা ও তার বাস্তবায়নের সাথে সম্পর্কিত। বিশেষতঃ বিশ্বমন্দার ঝুঁকি এবং মানি লন্ডারিংকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তথা নীতিনির্ধারকরা আইন প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে বড় ধরণের পরিবর্তন এনেছে। যার ফলশ্রæতিতে সার্বিকভাবে ব্যাংক ব্যবস্থাপনায় কৌশলগত পরিবর্তন এসেছে। আর এর সাথে সঙ্গতি রেখে ব্যাংকগুলোতে মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনায়ও পরিবর্তন আনতে হয়েছে। নীতি নির্ধারণী তথা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী ব্যাংকিং খাতের নেতৃত্বের মাঝেও সঙ্গতিপূর্ণ পরিবর্তন বাঞ্চনীয়। বর্তমান পরিস্থিতিকে সামনে রেখে ব্যাংকিং খাতের নেতৃত্ব তাদের প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুদক্ষ মানব সম্পদের সমন্বয়ে এমন একটি পরিবেশ তৈরী করবেন যা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার চাহিদা অনুযায়ী ভূমিকা পালনের সাথে সাথে ভোক্তার সন্তুষ্টি ও শেয়ার হোল্ডারদের প্রত্যাশা পূরণে সচেষ্ট হবে। পরিবর্তিত পরিস্খিতি মোকাবেলায় বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলো মানব সম্পদ নিয়োগ ও পুনঃবন্টনে মনোযোগ দিচ্ছে। এবং কিছু বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অধিকতর হারে প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে দক্ষ মানব সম্পদ গঠনে সচেষ্ট হচ্ছে। বোধহয় সবচেয়ে জোরে শোরে নিয়ন্ত্রক সংস্থারা আজকাল নৈতিকতা, পেশাগত সংস্কৃতি এবং জবাবদিহিতার বিষয়গুলোকে বিধিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সন্নিবেশিত করছেন। মূলতঃ ভবিষ্যৎ মন্দা মোকাবিলা ও টেকসই আর্থিক খাতের তাগিদেই এহেন পদক্ষেপসমূহ। নীতিপ্রণেতা এবং নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার এরূপ চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে দক্ষ মানব সম্পদে বিনিয়োগ বর্তমানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবসা কৌশল নির্ধারণে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।

বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে, অধিক হারে চাকুরী পরিবর্তনের প্রবণতা, মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনাকে প্রভাবিত করছে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিচালনগত বিষয়টি অভিজ্ঞ কর্মীদের উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল বিধায় প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে কর্মীদের চাকুরী পরিবর্তনের উচ্চ হার কখনোই কাম্য নয়। নতুন কর্মীদের সমাগম স্বল্প সময়ের মধ্যে এ ধরণের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে না। ব্যাংক মূলতঃ দক্ষ কর্মীভিত্তিক প্রতিষ্ঠান। অধিক হারে বার বার কর্মী নিয়োগ বা কর্মীদের চাকুরী পরিবর্তন হলে ব্যাংকের পরিচালনগত ব্যয়ও বৃদ্ধি পায়। সঠিক কর্মী নির্বাচন, নিয়োগ, তাদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান সর্বোপরি দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনবলের সংকট এ সবই ব্যাংকের ব্যয়ের সাথে সংশ্লিষ্ট। এছাড়া চাকুরী পরিবর্তনের উচ্চ হার প্রতিষ্ঠানের কাঙ্খিত সাফল্য অর্জনকে বাধাগ্রস্ত করে। তবে শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠান নয়, চাকুরী পরিবর্তনের ফলে কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মীও ক্ষতির সম্মুখীন হন। কর্মীরা দীর্ঘমেয়াদী লাভ থেকে বঞ্চিত হতে পারেন, বা নতুন চাকুরী পূর্বের চেয়ে অনেক ক্ষেত্রে স্বাচ্ছ্যন্দদায়ক নাও হতে পারে। তবে ব্যয়ের বিষয়টি বিবেচনায় না নিলে চাকুরী পরিবর্তন প্রতিষ্ঠান এবং কর্মী উভয়ের জন্য লাভজনকও হতে পারে। একদিকে প্রতিষ্ঠান ব্যয় হ্রাসের পাশাপাশি অদক্ষ জনবলের স্থলে দক্ষ ও নতুন জনবল নিয়োগ করতে পারে, অন্যদিকে একজন ব্যাংক কর্র্মীর বেতন, পদমর্যাদা এবং সামাজিক অবস্থানেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে পারে। কোন কোন ক্ষেত্রে চাকুরী পরিবর্তনের কম হার কোন খাতের নেতিবাচক দিক হিসেবেও বিবেচিত হয়। যেমন ক্ষতিগ্রস্ত বা অ-লাভজনক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে চাকুরী পরিবর্তনের প্রবণতা অনেক কম এমন নজির রয়েছে। তবে সাধারণভাবে চাকুরী পরিবর্তনের উচ্চহার এবং নি¤œহার উভয়ই একটি খাতের জন্য ক্ষতিকর হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের সাথে সঙ্গতি রেখে একটি টেকসই ও অন্তর্ভূক্তিমূলক ব্যাংকিং খাতের বাস্তবায়ন অত্যন্ত জরুরী। একটি সময়োচিত পদক্ষেপ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বেশ কিছু ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেশের পশ্চাৎপদ জনগণকে আর্থিক সেবার আওতায় আনার জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ব্যাংকিং খাতের এসব কার্যক্রম ও পদক্ষেপ ইতোমধ্যেই আর্থিক অন্তর্ভূক্তি, পরিবেশ সম্পর্কিত সচেতনতা ও গ্রামীণ উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। এ ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশী লক্ষণীয় পরিবর্তন এনেছে ব্যাংকিং সেবায় তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহার । মনে করা হচ্ছে ডিজিটাল ব্যাংকিং সেবা অন্তর্ভূক্তিমূলক ব্যাংকিং এর বিকাশে বড় ধরণের পরিবর্তন আনবে। আর্থিক অর্ন্তভূক্তি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও দারিদ্রতা দূরীকরণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। দেশের একটি বড় অংশকে এখনো বিদ্যমান ব্যাংকিং সেবার আওতায় আনা যায়নি। বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং বেশ কিছু ব্যাংকের পদক্ষেপের পরেও একটি বড় অংশের নি¤œ আয়ের মানুষ ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসলেও, তাদের ব্যাংকের ঋণ সেবার আওতায় আনার জন্য ব্যাপক পরিবর্তন প্রয়োজন। কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে ঋণ ও সেবা ব্যতীত আমাদের মত দেশে একটি টেকসই ব্যাংকিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের বেশীর ভাগ জনগণ এখনো কৃষি ও গ্রামীণ অর্থনীতির উপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভরশীল। আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত, দেশের কৃষি ও গ্রামীণ খাতের প্রয়োজন অনুযায়ী খুব সামান্যই ঋণ ও আনুষঙ্গিক সেবা প্রদান করতে পেরেছে। আপতঃদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, যদিও মোবাইল বা ব্যাংকিং এজেন্টের মাধ্যমে খুব সহজে নি¤œ আয়ের জনগোষ্ঠী এবং প্রত্যন্ত এলাকার মানুষদের কাছে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছানো সম্ভব, তবে এ ধরণের সার্বিক কর্মকান্ডকে আর্থিক সেবা নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার নজরদারীতে থাকার প্রয়োজন আছে। বিশেষতঃ মোবাইল এবং অন্যান্য ব্যাংকিং এজেন্টদের অবশ্যই যথাযথ নজরদারী ও দায়বদ্ধতার আওতায় আনা না হলে তারা অর্থ লেনদেন সংক্রান্ত অবৈধ কাজকর্মে লিপ্ত হতে পারে অথবা অবৈধ চক্রের সহযোগী হয়ে উঠতে পারে। এছাড়া এ সংক্রান্ত অপরাধ মোকাবিলায়ও পর্যাপ্ত পদক্ষেপ গ্রহণের সুযোগ আছে।

ব্যাংকিং খাতের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা এবং গবেষণা কর্মকান্ডের মানোন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব্ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। বিগত কয়েক বছর ধরে গতানুগতিক শিক্ষাগত গবেষণার পাশাপশি ব্যাংকিং খাত সম্পর্কিত বিষয়সমূহে গবেষণা কর্মকান্ডের মাধ্যমে ব্যাংক কর্মকর্তা/ নির্বাহীদের আকর্ষণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিআইবিএম। এসব গবেষণাসমূহ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা ও পরিচালনা উন্নয়নের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর মানোন্নয়নে ভ‚মিকা রাখছে বলে মনে করি। প্রায়োগিক ও বাস্তবধর্মী উপস্থাপন অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের এ গবেষণা দলিলগুলোকে কার্যক্ষেত্রে ব্যবহার করতে অনুপ্রাণিত করছে। কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ব্যাংকারদের গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত করে গবেষণা পত্রগুলোকে অধিকতর বাস্তবধর্মী ও প্রায়োগিক করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। এর ফলে অধিক সংখ্যক ব্যাংকারও এ ধরণের গবেষণা কর্মে উৎসাহ দেখাচ্ছে। এ ধরণের ইতিবাচক প্রবণতা বিআইবিএম-এর গবেষণা সংক্রান্ত কর্মকান্ডেও উৎসাহ জোগাচ্ছে।

বিআইবিএম এর আঞ্চলিক ব্যাংকিং সম্মেলন এ ধরনের আয়োজন যা এর পরিসরকে আরও বাড়িয়েছে। আঞ্চলিক ব্যাংকিং সম্মেলন ২০১৮ আয়োজনে বিআইবিএম এর সাথে সহযোগী হয়েছে ভারত এর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব্ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (এনআ্ইবিএম); নেপাল এর ন্যাশনাল ব্যাংকিং ইনস্টিটিউট (এনবিআই) এবং ভ‚টান এর ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (ফিটি)। আর্থিক অন্তর্ভূক্তি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং দ্বিতীয় সেশনটির বিষয় ব্যাংকিং খাতের মানব সম্পদ উন্নয়ন। আমরা আশা করি ২য় দিনের আলোচনায় ব্যাংকিং খাতের মানব সম্পদ উন্নয়ন , ঝুকি ব্যবস্থাপনা ও অর্থিক অর্ন্তভুক্তি সংক্রান্ত পরিস্থিতির তুলনামূলক চিত্র উপস্থাপিত হবে এবং সমস্যা ও সমাধানের পথনির্দেশনা থাকবে। সার্বিক ভাবে, আমার বিশ্বাস বিআইবিএম-এর আঞ্চলিক সম্মেলন ব্যাংকিং খাতের সমস্যা ও সমাধানসমুহকে উপস্থাপনের মাধ্যমে আমাদের ভবিষ্যৎ পথ চলায় নির্দেশনা দেবে। আজ আমরা সম্মেলন শেষ করবো একটি সঙ্গীত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। পরবর্তী সময়ে এমনই একটি জ্ঞানচর্চা সমাবেশের অপেক্ষায় রইলাম।

লেখক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব্ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর অধ্যাপক ও পরিচালক প্রশিক্ষণ হিসেবে কর্মরত আছেন এবং আঞ্চলিক ব্যাংকিং সম্মেলন-২০১৮ এর কার্যকরী কমিটির সভাপতি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *