ব্যাংকিং খাতে বাস্তবধর্মী এবং প্রায়োগিক অধিক গবেষণা আবশ্যক

April 28, 2020
2777
Views

ব্যাংকিং খাতে বাস্তবধর্মী এবং প্রায়োগিক অধিক গবেষণা আবশ্যক
(বণিক বার্তায় ২০১৮ সালে প্রকাশিত)
-ড. শাহ্ মোঃ আহসান হাবীব
গবেষণা একটি সুব্যবস্থিত অনুসন্ধান, যার মাধ্যমে পদ্ধতিগতভাবে প্রকৃত সত্য, আন্তঃসম্পর্ক এবং নতুন তথ্যের উম্মোচন হয়। গবেষণা এবং অনুসন্ধানের মাধ্যমে অর্জিত সত্য সমস্যা সমাধানের একটি বহুল পরিচিত, গ্রহণযোগ্য এবং রীতিবদ্ধ পদ্ধতি। অর্থনীতির যে কোন ক্ষেত্রে বাস্তবধর্মী ও প্রায়োগিক গবেষণা সময়োচিত পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধন করতে পারে। আর্থিক ও ব্যাংকিং খাত প্রতিনিয়ত পরিবর্তন হচ্ছে এবং এর কার্যক্রম নতুন নতুন ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে, যেখানে এ ধরণের অনুসন্ধানের প্রয়োজনীয়তা আরো অধিক। এ লেখাটি বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের উন্নয়নে বাস্তবধর্মী ও প্রায়োগিক গবেষণার প্রয়োজনীয়তার সপক্ষে কিছু যুক্তি উপস্থাপন করেছে।

অর্থনীতির অন্যান্য খাতের ন্যায় ব্যাংকিং খাতেও গবেষণা বা তথ্য অনুসন্ধান নতুন নতুন সত্যের উম্মোচন করছে, সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখছে। একই সাথে উদ্ধুত পরিস্থিতিতে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণের জন্য দিক নির্দেশনা প্রদান করে চলেছে। এক্ষেত্রে মাত্রাগত পরিমাণ বিশ্লেষণ যেমন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তেমনি পরীক্ষামূলক ও বর্ণনামূলক অনুসন্ধানও যথাযথ ভ‚মিকা রাখতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার অংশ হিসেবে ব্যাংক ও আর্থিক খাতের গবেষণাসমূহ বিভিন্ন গবেষণা সাময়িকী বা জার্ণাল-এ প্রকাশিত হয়ে থাকে। এ সমস্ত গবেষণা যে শিক্ষা বিকাশ বা কর্মক্ষেত্রে ভ‚মিকা রাখে সন্দেহ নাই, তবে শুধূমাত্র গবেষণার জন্য গবেষণার ও অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। বরং সে তুলনায় প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক গবেষণার উদাহরণ কম, যা আর্থিক বা ব্যাংকিং খাতের কার্যক্রম এর সাথে সরাসরি সম্পর্কিত। বাংলাদেশের আর্থিক ও ব্যাংকিং খাত নিয়ে আমরা যে প্রতিনিয়ত গবেষণা বা অনুসন্ধান করে চলেছি -তা হয়তো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের তথ্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করছে; গবেষকের জ্ঞান বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে; কিন্তু ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের প্রকৃত সমস্যা সমাধানে বাস্তবধর্মী ও গ্রহণযোগ্য সমস্যাসমূহের সমাধানগুলো অনেক ক্ষেত্রেই তুলে আনতে পারছে বলে মনে হয় না। এক্ষেত্রে প্রায়োগিক গবেষণা অনেক বেশী অবদান রাখতে পারে বলে মনে করছি।

কার্যকরী গবেষণার একটি মূল্যবান ক্ষেত্র হলো যথাযথ গবেষণা পদ্ধতি চয়ন। এক্ষেত্রে গাণিতিক ও পরিসংখ্যানের উপাদান/কৌশল ও মডেল অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য- যা তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে মাত্রা ও পরিমাণ নির্ধারণে বিশেষ কার্যকরী। গুণগত বিশ্লেষণ গবেষণার আরেকটি উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি। তবে মাত্রা ও গুণগত বিশ্লেষণ এর সামগ্রিক প্রয়োগ গবেষণাকে অনেক বেশী গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। বিশেষতঃ প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক গবেষণায় মাত্রা ও গুণগত বিশ্লেষণের সামগ্রিক প্রয়োগ প্রকৃত সমস্যা উদ্ঘাটন ও সমাধানে অত্যন্ত কার্যকরী ভ‚মিকা রাখতে পারে। সঠিক গবেষণা পদ্ধতি চয়ন ও তার ব্যবহার একটি গবেষণা বা অনুসন্ধানের অত্যন্ত মূল্যবান দিক তবে, এটিকে অনেক বেশী ব্যবহারযোগ্য ও সহজবোধ্য করার জন্য গবেষণা পদ্ধতির কাঠামো বা মাত্রাগত বিশ্লেষণের প্রয়োগের ক্ষেত্রে একজন গবেষকের অনড় অবস্থান কাম্য নয়।

ব্যাংকিং খাত পরিচালনে এবং নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণে গবেষণাকে সম্পৃক্ত করতে হলে তা বাস্তবসম্মত ও সুনির্দিষ্ট সমস্যা বিষয়ক হওয়া প্রয়োজন এবং তা অবশ্যই সহজবোধ্য, গ্রহণযোগ্য এবং ব্যবহারযোগ্য হতে হবে। প্রকৃতপক্ষে গবেষণা বা অনুসন্ধানকে ব্যবহারযোগ্য করে তোলা একটি অত্যন্ত বড় চ্যালেঞ্জ। গবেষণালব্ধ জ্ঞান ও ফলাফল যদি কার্যক্ষেত্রে কাজে লাগে, তবেই তার প্রকৃত সফলতা। সেক্ষেত্রে বাংকিং খাতের বাস্তবধর্মী সমস্যা ও কার্যপ্রণালীকে সামনে রেখে প্রায়োগিক বা ব্যবহারিক ব্যাংকিং গবেষণাকে চয়ন করা প্রয়োজন এবং সহজবোধ্য গবেষণাপত্র তৈরী করে তা ব্যাংকিং খাতের পেশাজীবিদের মাঝে পৌঁছে দেয়া আবশ্যক। তবেই এ ব্যাংকিং খাতের সাথে যারা জড়িত তারা এ সংক্রান্ত গবেষণার সাথে নিজেদের সম্পৃক্ততা খুঁজে পাবেন। আর এ জন্য বাস্তবধর্মী গবেষণা উপস্থাপনের ক্ষেত্রে কৌশলী হওয়া প্রয়োজন। একটি মাত্রাগত বিশ্লেষণধর্মী গাণিতিক গবেষণা সাধারণভাবে সবার কাছে বোধগম্য নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে তার সহজ উপস্থাপনের কৌশল অবলম্বন অত্যন্ত জরুরী। সহজ উপস্থাপন একটি গবেষণা ও অনুসন্ধানকে অংশীদারী পক্ষের কাছে নিয়ে যায়, তাদেরকে ভাবতে প্রণোদনা দেয় বা বাধ্য করে। সহজ উপস্থাপনের জন্য যদি গবেষণা পদ্ধতির সাথে আপোষের প্রয়োজন হয়, তবুও তা কোন কোন ক্ষেত্রে কাঙ্খিত হতে পারে। নতুন অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে অধিক বর্ণনামূলক ও প্রেরণামূলক উপস্থাপন সংশ্লিষ্ট খাত ও পেশাজীবিদের আকর্ষণ করতে পারে। কোন একটি নতুন বিষয়কে সবার সামনে নতুন আঙ্গিকে পদ্ধতিগতভাবে উপস্থাপন জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করার পাশাপাশি চিন্তার খোরাক জোগায়।

আপাতঃদৃষ্টিতে একটি গবেষণার সহজবোধ্য, বর্ণনামূলক এবং গুণগত উপস্থাপন খুব সাধারণ ও সহজ মনে হলেও এ ধরণের অনুসন্ধানের গ্রহণযোগ্যতা নিরূপণ এবং আবেদন বাড়াতে অধিক দক্ষতার প্রয়োজন। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি একজন নতুন গবেষককে প্রাথমিকভাবে প্রথাসিদ্ধ নিয়মের মধ্যে থেকে এবং মাত্রাগত বিশ্লেষণ প্রয়োগ করেই গবেষণার জ্ঞানকে শাণিত করা প্রয়োজন। এ ধরণের গবেষণা মূলতঃ শিক্ষামূলক হবে যা স্বনামধন্য গবেষণাপত্রগুলোতে প্রকাশনার প্রচেষ্টা থাকবে। এ ধরণের প্রকাশনা এক প্রকার মূল্যায়ন এবং প্রণোদনাও বটে। তবে পেশাগত জীবনে একজন গবেষকের পরিপক্কতার সাথে সাথে অবশ্যই গবেষণা যাতে উদ্দেশ্যপূর্ণ হয়, সেদিকে খেয়াল রাখা প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে যারা গবেষণাটির সম্ভাব্য ব্যবহারকারীদের-কে সামনে রেখেই গবেষণার বিষয়, পদ্ধতি ও উপস্থাপন নির্ণয় করা বাঞ্ছনীয়।

ব্যাংকিং খাতের প্রশিক্ষণ, শিক্ষা এবং গবেষণা কর্মকান্ডের মানোন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব্ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)। বিগত কয়েক বছর ধরে গতানুগতিক শিক্ষাগত গবেষণার পাশাপশি ব্যাংকিং খাত সম্পর্কিত বিষয়সমূহে গবেষণা কর্মকান্ডের মাধ্যমে ব্যাংক কর্মকর্তা/ নির্বাহীদের আকর্ষণ করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বিআইবিএম। এসব গবেষণাসমূহ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের সমস্যা ও পরিচালনা উন্নয়নের পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর মানোন্নয়নে ভ‚মিকা রাখছে বলে মনে করি। প্রায়োগিক ও বাস্তবধর্মী উপস্থাপন অনেক ক্ষেত্রে ব্যাংকারদের এ গবেষণা দলিলগুলোকে কার্যক্ষেত্রে ব্যবহার করতে অনুপ্রাণিত করছে। কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে ব্যাংকারদের গবেষণার সাথে সম্পৃক্ত করে গবেষণা পত্রগুলোকে অধিকতর বাস্তবধর্মী ও প্রায়োগিক করার প্রচেষ্টা করা হচ্ছে। এর ফলে অধিক সংখ্যক ব্যাংকারও এ ধরণের গবেষণা কর্মে উৎসাহ দেখাচ্ছে। এ ধরণের ইতিবাচক প্রবণতা বিআইবিএম-এর গবেষণা সংক্রান্ত কর্মকান্ডে উৎসাহ জোগাচ্ছে।

প্রায়োগিক ও বাস্তবধর্মী গবেষণায় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগেরও সম্পৃক্ত হওয়া আবশ্যক। বিশেষতঃ যারা প্রশিক্ষণ এর সাথে জড়িত তারা গবেষণার পদ্ধতি ও উপস্থাপনাকে ব্যবহার করে ব্যবহারযোগ্য গবেষণা দলিল তৈরী করতে পারেন। নিজের ব্যাংকের ছোট ছোট সমস্যা ও পরিচালন বিষয়ে গবেষণা কর্ম ও অনুসন্ধান, তথ্য ভান্ডার হিসেবে সংরক্ষণ একটি ব্যাংকের মানব সম্পদ উন্নয়নে অবদান রাখার পাশাপাশি এর মূল উদ্দেশ্যে ও লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা রাখতে পারে। তবে এ ধরণের প্রায়োগিক অনুসন্ধানে গবেষকের কার্যক্রমে গবেষকের ব্যাংকিং সম্পর্কিত পরিচালন জ্ঞান গবেষণার ব্যবহার যোগ্যতাকে বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। এ ক্ষেত্রে একজন ব্যাংকারকে উচ্চতর শিক্ষা বা পিএইচডি গ্রহণ করে এ ধরণের গবেষণা কর্মকান্ডে সম্পৃক্ত হতে হবে এমনটি মনে করি না। তবে ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের নির্দিষ্ট সংখ্যক ব্যাংকার এ কাজে প্রশিক্ষিত হতে পারেন। বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে প্রায়োগিক বা বাস্তবভিত্তিক গবেষণা উপস্থাপন ও এর কার্যক্ষেত্রে ব্যবহারের কৌশলকেই মূল হিসেবে মনে করছি। গবেষণার জন্য গবেষণা নয়, গবেষণা হোক মানুষের জন্য, কর্মক্ষেত্রে ব্যবহারের জন্য।

লেখক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব্ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর অধ্যাপক ও পরিচালক (প্রশিক্ষণ)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *