করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরূদ্ধার সবুজ ও টেকসই হওয়া প্রয়োজন
অধ্যাপক শাহ্ মোঃ আহসান হাবীব
করোনা যুদ্ধের মাঝেই বিশ্বব্যাপী নীতি নির্ধারকদের করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা থেকে বের হবার রাস্তা খুজঁতে হচ্ছে এবং সে অনুযায়ী প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হচ্ছে। পূর্বের যেকোন অর্থনৈতিক মন্দার থেকে বর্তমান ও আগত মন্দা পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা। সমস্ত পূর্বাভাস বলছে আগত অর্থনৈতিক মন্দা ১৯৩০ এর বিশ্ব মন্দাকে হার মানাবে। বস্তুতঃ সে তুলনাও গ্রহণযোগ্য মনে হয় না। ১৯২৯ সাল থেকে শুরু করে ১৯৩০ দশকের বিশ্বমন্দার প্রভাব পৃথিবীকে গ্রাস করতে সময় নিয়েছে এক থেকে তিন বছর। সেখানে করোনা পরিস্থিতিতে এক মাসের কম সময়ের মধ্যে সারাবিশ্ব মারাত্মক মন্দায় পতিত হয়েছে বা হচ্ছে। করোনা পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব হলে, সকলের সমন্বিত প্রচেষ্ঠায় হয়তোবা স্বল্প সময়ের মধ্যে অর্থনীতিকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, কবে নাগাদ করোনা পরিস্থিতি সামলানো সম্ভব হবে? এ অনিশ্চয়তা স্পষ্ট। এছাড়া করোনা থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা কি একটি টেকসই অর্থনৈতিক পুনরূদ্ধার এর প্রচেষ্টা চালাবো, নাকি গতানুগতিক উন্নয়ন এর ধারাকে অব্যাহত রাখবো?
বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক পুনরূদ্ধার পদ্ধতি ও প্রস্তুতি বেশ আলোচিত হচ্ছে। ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে এই অর্থনৈতিক পুনরূদ্ধার পরিকল্পনায় পরিবেশ ঝুঁিক যথার্থ কারনেই আলোচনায় উঠে আসছে। বর্তমান উন্নয়নের ধারা এবং পদ্ধতি যে পুরোপুরি টেকসই নয় তা বলার অপেক্ষা রাখে না, শুধুমাত্র করোনা পরিস্থিতি আবার তা অত্যন্ত জোরালো ভাষায় মানবজাতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। বারবার বিভিন্ন ধরনের মহামারী আমাদের উন্নয়নের ধারাকে ব্যাহত করছে, শিক্ষা দিতে চেয়েছে। দুর্ভাগ্যবশতঃ বারবারই আমরা পরিবেশ ও প্রকৃতিকে বিপর্যয়ের মাঝে ঠেলে দিয়ে গতানুগতিক আধুনিকায়ন ও উন্নয়নের ধারায় মনোনিবেশ করেছি। করোনা এবং বিশ্ব অর্থনীতির এবারের বিপর্যয় কি সে ধারায় পরিবর্তন আনতে পারবে?
বিশ্বব্যাপী মানবজাতির উন্নয়ণ ও আধুনিকায়ন এর পদ্ধতির সাথে প্রানঘাতি ভাইরাসের সংক্রমণ, প্রসার এবং বারবার ফিরে আসার সম্পৃক্ততা আছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে আমরা নির্দিষ্ট কিছু পশুপাখির জন্ম ও বিস্তারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছি, আবার হারিয়ে গেছে অনেক প্রজাতির প্রানী ও গাছপালা। মানুষের গতিবিধি চলাফেরা আর যাতায়াতের বৃদ্ধির সাথে সাথে পশুপাখিরও বিশ্বব্যাপী পরিবহণ বেড়েছে।
বিভিন্ন দেশের ও সম্প্রদায়ের মানুষের বিশ্বব্যাপী স্থানান্তর হয়েছে এবং বিশ্বব্যাপী অবাধ চলাচলের রাস্তা প্রসারিত এবং নিয়মকানুন সহজ থেকে সহজতর হয়েছে। আধুনিকায়ন এবং উন্নয়ণের অসংখ্য প্রকল্প বিশ্বব্যাপী পরিবর্তনের সাথে সাথে প্রকৃতি ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর প্রভাব বয়ে এনেছে। “ডবিøউএইচও” এর ওয়েবসাইটে একটি গবেষণার উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, জনতাত্তি¡ক, পরিবেশগত, সামাজিক, প্রযুক্তিগত এবং মানবজাতির জীবন ধারার পরিবর্তনের সাথে সাথে জলবায়ু পরিবর্তন এবং সংক্রামক রোগ জীবানুর বিস্তৃতি ও প্রসারের সম্পর্ক আছে। যেমন ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গু রোগের বিস্তারের জন্য বিভিন্ন উন্নয়ণমূলক প্রকল্পের আওতায় প্রস্তুতকৃত ছোট বড় জলাশয়গুলো মশার প্রজনণক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছে। উন্নয়নের অনেকক্ষেত্রেই মানবজাতি প্রকৃতির বিরূদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এবং প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য অনেকটাই বিনস্ত করে ফেলেছি আমরা। প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়ম মারাত্মকভাবে ব্যাহত ও বাধাগ্রস্ত হয়েছে মানবজাতির উন্নয়ণের সাথে সাথে।
“জেনেটিক্যালি মোডিফাইড ফুড” “ক্লোনিং” এসব হয়ত উন্নয়ণের নতুন দিক-নির্দেশনা দিতে শুরু করেছে আর এসবের উপকারও অস্বীকার করা যায় না। তবে এর মধ্য দিয়ে কোন না কোন ভাবে প্রকৃতির বিরূদ্ধে দাড়িঁয়েছে মানবজাতি। এর দুইরকম প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়ঃ ভয় এবং আশা। একটি পক্ষ মনে করে, এটা অত্যন্ত ভয়ের, এর মাধ্যমে আমরা আসলে সৃষ্টিকর্তাকে চ্যালেঞ্জ করছি, তার নিয়মের বিরূদ্ধাচরণ করছি। আরেক পক্ষ মনে করে, এগুলো বড় ধরনের সফলতা এবং এর মাধ্যমে মানবজাতি প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হবে এবং মানবজাতির অধিক কল্যাণ সাধিত হবে ।
“ঊহফ ড়ভ ঃযব ঘধঃঁৎব” ১৯৭০ সালের মানবজাতির প্রকৃতি বিরূদ্ধ আচরণের উপড় লিখা একটি বিখ্যাত গ্রন্থে লেখক যথার্থই বলেছেন, হয়ত প্রকৃতি বা পৃথিবী ধ্বংস হবে না, সূর্যও উঠবে, বৃষ্টিও হবে, তবে আগের মত নয়। এ এক রূপান্তরিত প্রকৃতি যেখানে মানবজাতির হস্তক্ষেপ এর প্রতিফলণ স্পষ্ট।
“বন্যরা বনে সুন্দর” আমরা পড়েছি, জেনেছি তবে মানিনি। প্রকৃতির মাঝে নয় বরং আমাদের মাঝে জন্ম ও বড় হতে অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্য করেছি পশুপাখিদের। আজ আমরা দেখছি, পশুপাখির সংস্পর্শ থেকে অনেক রোগ জীবাণুর বিস্তৃতি হয়েছে মানুষের মাঝে। যুক্তরাষ্ট্রের “সেন্টার ফর ডিজেজ কন্ট্রোল এন্ড প্রিভেনশন” এর তথ্য অনুসারে চারভাগের তিনভাগ সংক্রামক রোগের সূত্র মানুষও পশুপাখির সংস্পর্শ।
প্রকৃতি বারবার শিক্ষা দিতে চেয়েছে মানবজাতিকে। আশাবাদীরা মনে করেন, করোনা পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী উন্নয়নের ধারা পরিবর্তিত হবে এবং আমরা প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখে নতুন বিশ্ব গড়ব, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেব। তবে হতাশাবাদীদের দল ভারী, যারা মনে করেন, করোনা পরবর্তী সময়ে আমরা এ সময়ের উৎপাদনের ক্ষতি পুষিয়ে নেবার জন্য নতুন উদ্যোগে উন্নয়ণ ও আধুনিকায়ন করব যথারীতি প্রকৃতির নিয়মের অগ্রাহ্য এবং পরিবেশের বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে। ইতিহাসের প্রমাণদি অবশ্য হতাশাবাদীদের পক্ষেই। অনেকক্ষেত্রে প্রকৃতি আমাদের তাৎক্ষণিকভাবে পরিবর্তিত ব্যাবস্থা নিতে বাধ্য করেছে। যেমন ১৯৫৮ সালে চীনের “পাখি বিরূদ্ধ প্রচারণা” বা “স্প্যারো ক্যাম্পেইন” ভয়ানক পরিনতি ডেকে আনলেও মানবজাতিকে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিরূদ্ধ কর্মকান্ড থেকে নিবৃত করতে পারেনি।
১৯৫৮ সালে তৎকালীন চীনের সাম্যবাদী সরকার কৃষিকে গুরুত্ব দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের কৌশল গ্রহণ করে এবং এর আওতায় ফসলের জন্য ক্ষতিকারক (যা প্রকৃতপক্ষে নয়) একটি অত্যন্ত প্রকৃতি নিয়ম বিরূদ্ধ সিদ্ধান্ত ও প্রচারনা শুরু করে যা ইতিহাসে “স্প্যারো ক্যাম্পেইন” নামে পরিচিত। এর মাধ্যমে চীনে নিষ্ঠুরভাবে অসংখ্য পাখি মেরে ফেলা হয়। পাখি মারাকে উৎসাহিত করার জন্য এ সময় পাখিগুলোকে সা¤্রাজ্যবাদের বন্ধ ু এবং সাম্যবাদের শত্রæ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। পাখি নিধনের পরিপ্রেক্ষিতে চীনে প্রকৃতি ভারসাম্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় এবং ব্যাপক ফসল হানি ঘটে। এর পরবর্তী তিন বছরে চীন ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে পতিত হয়। বলা হয়, দেড় থেকে সাড়ে চার কোটি মানুষ এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে প্রান হারায়। পরিবেশের ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে এ সময়ে চীন সরকারকে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ২ লক্ষ ৫০ হাজার পাখি আমদানী করে আনতে হয়েছিল।এধরনের অনেক ঘটনা বারবার আমাদের শিক্ষা দিতে চেয়েছে। শিক্ষা প্রকৃতি ও পরিবেশের নিয়মতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধার। শিক্ষা প্রকৃতি ও ভারসাম্য রক্ষার।
করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে একটি টেকসই অর্থনৈতিক পুণঃরূদ্ধার কৌশল এর জন্য অবশ্যই বিশ্বব্যাপী প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্যের উপাদানগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের যথাযথ প্রথা থেকে সরে আসতে হবে। পুনঃনবায়নযোগ্য শক্তি ও বিদ্যুৎ ব্যবহারের কথা ভাবতে হবে। বায়ু ও পানি দূষণের বিরূদ্ধে দাড়াঁতে হবে। প্রাকৃতিক সম্পদের সংরক্ষণের ব্যাবস্থা নিতে হবে এবং সর্বোপরি জলবায়ু পরিবর্তণের প্রভাব থেকে মানবজাতিকে রক্ষায় এক হয়ে কাজ করতে হবে। পুনঃরূদ্ধার কৌশলের অংশ হিসেবেই শুরু হতে পারে প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করে উন্নয়ণ কৌশলের যাত্রা।
সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় আমাদের । প্রথমতঃ, প্রকৃতি ও পরিবেশের সামঞ্জস্য রক্ষা করে আমরা এই স্বনিয়ন্ত্রিত প্রাকৃতিক ব্যাবস্থার ছায়ায় জীবনকে সুন্দর করতে পারি। সেক্ষেত্রে প্রাকৃতিক ব্যবস্থা ও সামঞ্জস্যপূর্ণ পরিবেশ মানবজাতির জন্য রোগজীবাণুর বিরূদ্ধে লড়বে। অথবা, দ্বিতীয়তঃ প্রকৃতি ও পরিবেশের বিরূদ্ধে আমরা আমাদের গতাণুগতিক লড়াই চালিয়ে যেতে পারি। এবং বারবার প্রকৃতি ও পরিবেশের প্রতিশোধের ও প্রানঘাতী রোগজীবাণুর মুখোমুখী হতে পারি। সেক্ষেত্রে এরকম আরো অনেক ভয়ঙ্কর করোনা হয়ত আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে।
গতাণুগতিক উন্নয়নের ধারায় আমরা নিজ নিজ জায়গা থেকে প্রকৃতি ও পরিবেশের বিরূদ্ধাচরণ করে চলেছি। এর জন্য সম্মিলিত উদ্যোগের প্রয়োজন নেই। আর যদি প্রথম বিকল্প অর্থাৎ পরিবর্তনের কথা ভাবতে হয়, প্রকৃতি ও পরিবেশের সামঞ্জস্য রক্ষার জন্য কাজ করতে হয় এবং করোনা পরবর্তী সময়ে টেকসই ও সবুজ পুনরূদ্ধার এর কৌশলের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হয়, তাহলে তা হতে হবে সমন্বিত এবং সম্মিলিত প্রয়াস। সেক্ষেত্রে প্রকৃতি ও পরিবেশ বিশ্বের সম্মিলিত প্রয়াসে সংযুক্ত হয়ে করোনার মত প্রানঘাতী রোগজীবানুর সাথে মানবজাতিকে রক্ষার প্রচেষ্ঠায় কাজ করবে।