বাংলাদেশ এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক রূপান্তরের সামনে। বহু বছরের প্রস্তুতি ও অগ্রগতির পর দেশটি জাতিসংঘের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উত্তরণের পথে। এই উত্তরণ জাতীয় অর্জনের স্বীকৃতি হলেও, আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি, শুল্কসুবিধা হ্রাস, কঠোরতর নিয়ম মেনে চলা এবং আর্থিক খাতে নতুন ঝুঁকির আবির্ভাব- সব মিলিয়ে বাংলাদেশের ব্যাংক ব্যবস্থার জন্য এটি একটি জটিল ও সংবেদনশীল সময়। বিশেষ করে বাণিজ্য অর্থায়ন ব্যবস্থায় চাপ বাড়বে এবং সাথে সাথে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচারের ঝুঁকিও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে।
এলডিসি সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ ইউরোপীয় ইউনিয়নের ‘এভরিথিং বাট আর্মস’ উদ্যোগের অধীনে প্রায় শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়েছে। মোট রপ্তানির প্রায় ৪৫ শতাংশ ইইউতে যায়, আর এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ পণ্য সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত। উত্তরণের পর এই সুবিধা ধীরে ধীরে কমে যাবে। ২০২৯ সালের পর যদি বাংলাদেশ ‘ইইউ জিএসপি-প্লাস’ সুবিধা অর্জন করতে না পারে, তবে তৈরি পোশাকে ৮ থেকে ১২ শতাংশ শুল্ক বৃদ্ধি পেতে পারে, যা রপ্তানিখাতের প্রতিযোগিতা কমিয়ে দেবে। যেহেতু তৈরি পোশাক বাংলাদেশের মোট রপ্তানির চার-পঞ্চমাংশ, তাই সামান্য শুল্কবৃদ্ধিও অর্থনীতিতে বড় চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশ প্রায় ৫.৩ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হারাতে পারে, যা সম্ভাব্য আয়ের ১৪ শতাংশ।
রপ্তানি আদেশ কমে যাওয়া, ক্রেতাদের অন্য দেশে সরে যাওয়া, উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি-এসব পরিবর্তন সরাসরি ব্যাংক ঋণ পোর্টফোলিওতে প্রভাব ফেলতে পারে। কর্মসম্পদ ঋণ, এলসি লাইন, সাপ্লাই চেইন ফাইন্যান্সিং-সব ক্ষেত্রেই চাপ বাড়বে। ফলে অনুৎপাদনশীল ঋণের ঝুঁকি বাড়বে, জামানতের মান কমবে এবং ব্যাংকের তারল্য পরিস্থিতিতে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। একইভাবে ওষুধশিল্পেও বড় পরিবর্তন আসবে। বর্তমান বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার আওতায় ‘ট্রিপ্স’ সুবিধার আওতায় বাংলাদেশ পেটেন্টমুক্ত ওষুধ উৎপাদন করে রপ্তানি বাড়াতে পেরেছে। উত্তরণের পর এই সুবিধা সীমিত হলে কোম্পানিগুলোর ব্যয় বাড়বে, উৎপাদন কাঠামো বদলাবে এবং ব্যাংকের ঋণ ঝুঁকি মূল্যায়ন আরও জটিল হবে।
এলডিসি উত্তরণের পর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর স্বল্পসুদে ঋণ পাওয়া কমে যাবে। বিশ্বব্যাংকের আইডিএ ঋণ সুবিধা সীমিত হলে সরকারকে তুলনামূলক ব্যয়বহুল ঋণের দিকে যেতে হবে। এতে বৈদেশিক ঋণ ব্যয় বাড়বে এবং সরকার দেশীয় ব্যাংকের ওপর নির্ভরতা বাড়াতে পারে, যার ফলে বেসরকারি খাতে ঋণ সরবরাহ সংকুচিত হতে পারে। জলবায়ু অভিযোজনেও চাপ বাড়বে, কারণ এলডিসি সুবিধার আওতায় যে গ্রান্ট ও বিশেষ তহবিল পাওয়া যেত তা উত্তরণের পর আর আগের মতো থাকবে না। ফলে সরকারকে এবং ব্যাংক খাতকে নিজস্ব তহবিল ব্যবহারের প্রস্তুতি নিতে হবে।
এদিকে, বাংলাদেশের ব্যাংক খাত নিজেও একটি কঠিন রূপান্তর পর্যায়ে আছে। দীর্ঘদিনের কাঠামোগত দুর্বলতা যেমন উচ্চ অনুৎপাদনশীল ঋণ, পুঁজির ঘাটতি, সুশাসন সমস্যা, আইনি জটিলতা, এবং ঋণ পুনরুদ্ধার ব্যবস্থার দুর্বলতা ব্যাংকগুলোকে চাপের মধ্যে রেখেছে। সুদহারের অনিশ্চয়তা, বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে অস্থিরতা, আমদানি-নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি এবং তারল্য সংকট ব্যাংকগুলোর সক্ষমতা আরও কমিয়ে দিয়েছে। অর্থাৎ, যখন বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার মোকাবিলায় উন্নত প্রযুক্তি, দক্ষ মানবসম্পদ, তথ্যনির্ভর বিশ্লেষণ এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ দরকার, তখনই ব্যাংকগুলো নিজেদের দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে ব্যস্ত। এই বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক মানের সহযোগিতা কাঠামো তৈরি করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। ফলে বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচারের মতো জটিল ও বহুমাত্রিক ঝুঁকি মোকাবিলার বাস্তব সক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই চাপের মুখে আছে।
এই পরিবর্তনগুলোর মাঝে সবচেয়ে বড় আর্থিক ঝুঁকিগুলোর একটি হলো বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার। নতুন বাজারে প্রবেশ, জটিল সাপ্লাই চেইন, উচ্চমূল্যের রপ্তানি এবং আর্থিক নীতির পরিবর্তনের ফলে অর্থপাচারের সুযোগ বাড়ে। ভুয়া চালান, অতিরিক্ত বা কম দামে মূল্যায়ন, ফ্যান্টম শিপমেন্ট, বহুস্তরীয় পেমেন্ট নেটওয়ার্ক ইত্যাদি এখন আরও উন্নত ও আন্তর্জাতিকভাবে সংগঠিত। দুর্বল নথিপত্র এবং সীমিত যাচাই-সক্ষমতা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।
সবচেয়ে কঠিন বাস্তবতা হলো, অর্থ একবার বিদেশে চলে গেলে তা পুনরুদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ধীর এবং অনেক ক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ। উৎস নথিপত্র দুর্বল হলে বিদেশি আদালতে মামলা এগিয়ে নেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। অর্থ সাধারণত এক দেশ থেকে আরেক দেশে ঘুরে ঘুরে বিভক্ত হয়ে যায়, ফলে তা শনাক্ত করাও কঠিন। তাই বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার মোকাবিলার ক্ষেত্রে প্রতিরোধই প্রধান কৌশল।
ব্যাংকগুলোকে এই ঝুঁকি মোকাবিলায় শুধু কমপ্লায়েন্সের ওপর নির্ভর করলে চলবে না। এটি এখন অপারেশনাল, সুনাম, বাণিজ্য এবং কৌশলগত ঝুঁকির সঙ্গে সম্পর্কিত। বিদেশি ব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক ঝুঁকিতে পড়তে পারে যদি নিয়ন্ত্রণ দুর্বল হয়। উচ্চ ঝুঁকির বাজার থেকে ব্যাংকগুলোকে পিছিয়ে আসতে হতে পারে। নতুন পণ্য উদ্ভাবন বা বাজার সম্প্রসারণে বাধা তৈরি হতে পারে। আন্তর্জাতিক নিয়ন্ত্রকদের বাড়তি নজরদারিও ব্যাংকের ওপর চাপ সৃষ্টি করবে।
তাই ব্যাংকগুলোকে ঝুঁকিব্যবস্থাপনায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে। রপ্তানিনির্ভর খাতগুলোর ঝুঁকি-পর্যালোচনা নতুনভাবে করতে হবে, যেখানে বাজারের চরিত্র, পণ্যের মূল্য, পরিবহণ ব্যবস্থার স্বচ্ছতা এবং গ্রাহকের আচরণ বিশ্লেষণ গুরুত্বপূর্ণ। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো আধুনিক করতে হবে এবং তথ্য বিশ্লেষণ, দামের তুলনামূলক বিশ্লেষণ, শিপমেন্ট ট্র্যাকিং, পরিবহনপথ বিশ্লেষণ পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে ঝুঁকি শনাক্তকরণ আরও শক্তিশালী করতে হবে। এক ব্যক্তির হাতে পুরো লেনদেনের দায়িত্ব না রেখে কাজ ভাগ করে দেওয়া দরকার, যাতে স্বচ্ছতা বাড়ে এবং ভুল বা অপব্যবহারের ঝুঁকি কমে।
বাংলাদেশের এলডিসি উত্তরণোত্তর বাস্তবতায় বাণিজ্য অর্থায়ন ও বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচার মোকাবিলায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়ন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। শুধু নিয়ম জানা নয়, বিশ্ববাজারের আচরণ, মূল্য পরিবর্তনের ধারা, ঝুঁকিপূর্ণ বাজারের বৈশিষ্ট্য বিষয়ে ব্যাংক কর্মকর্তাদের দক্ষতা বাড়াতে হবে। বৈশ্বিক বাজারের মূল্যধারা, পরিবর্তিত বাণিজ্য নীতি, পণ্যমূল্য নির্ধারণের জটিলতা, শুল্ক কাঠামোর পরিবর্তন এবং ঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্য আচরণ সম্পর্কে গভীর ধারণা না থাকলে সঠিক ঝুঁকি মূল্যায়ন সম্ভব নয়। একই সঙ্গে জটিল নথিপত্র যাচাই, তথ্য বিশ্লেষণ-নির্ভর পর্যবেক্ষণ, সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্তকরণ এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উন্নত প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। নতুন বাজারে প্রবেশ, জটিল সাপ্লাই চেইন এবং উচ্চঝুঁকিপূর্ণ বাণিজ্য রুটের প্রভাব বোঝার মতো ক্ষমতা তৈরি না হলে ব্যাংক খাত কার্যকরভাবে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তাই নিয়মিত প্রশিক্ষণ, প্রায়োগিক কর্মশালা, কেস স্টাডি ভিত্তিক শিক্ষণ এবং প্রযুক্তিনির্ভর সক্ষমতা বৃদ্ধি কর্মসূচির মাধ্যমে কর্মকর্তাদের দক্ষতা উন্নয়নই হতে পারে এলডিসি-পরবর্তী প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে নিরাপদ ও টেকসই ব্যাংক ব্যবস্থাপনার মূল ভিত্তি।
ব্যবসা, আইন পরিপালন ও কৌশল বিভাগ একসঙ্গে কাজ করলে ঝুঁকি শনাক্তকরণ আরও নির্ভুল হবে। নিয়মিত ঝুঁকি বিশ্লেষণের মাধ্যমে ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের প্রভাব আগেভাগে বোঝা যায়, যেমন কোনো অঞ্চলে ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা বা নকল পণ্যের প্রবাহ বাড়লে সেই অঞ্চলে অর্থপাচারের ঝুঁকি কীভাবে বাড়তে পারে তা আগেই মূল্যায়ন করা সম্ভব। ঝুঁকি গ্রহণক্ষমতা কাঠামোতেও বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচারকে কৌশলগতভাবে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। কোন গ্রাহক বা বাজারে প্রবেশ যুক্তিসঙ্গত, কোথায় সীমা টানতে হবে এসব সিদ্ধান্ত পরিচালনা পর্ষদ পর্যায়ে নিতে হবে। নেতৃত্বের দৃশ্যমান অংশগ্রহণ থাকলে ব্যাংক বা পুরো প্রতিষ্ঠান জুড়ে ঝুঁকি সচেতনতা বাড়তে বাধ্য।
কখনো কখনো ব্যাংকগুলোর কঠিন সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রস্তুতিও থাকতে হবে। যদি কোনো গ্রাহক বারবার সন্দেহজনক লেনদেন করে বা কোনো পরিবহন পথ অতিরিক্ত ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে, তাহলে সেই ব্যবসা থেকে সরে আসা দীর্ঘমেয়াদে ব্যাংকের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। স্বল্পমেয়াদে এটি ক্ষতিকারক মনে হলেও, দীর্ঘমেয়াদে এটি ব্যাংকের সুনাম ও স্থিতিশীলতার জন্য কার্যকরী।
বাংলাদেশ এলডিসি উত্তরণের পর এমন এক পৃথিবীতে প্রবেশ করছে যেখানে প্রতিযোগিতা বেশি, নিয়ম কঠোর, এবং বাণিজ্যভিত্তিক অর্থপাচারের ঝুঁকি আরও গভীর। এই সময়ে ব্যাংক খাত যদি ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা শক্তিশালী করে, প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি বাড়ায়, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ করে এবং কৌশলগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে উত্তরণ উন্মোচন করতে পারে নতুন সম্ভাবনার দ্বার। আর্থিক খাতের এসব প্রস্তুতিই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ কতটা স্থিতিশীল, নিরাপদ এবং প্রতিযোগিতামূলকভাবে এই নতুন অধ্যায়ে এগোতে পারবে।


