(বর্ণিক বার্তায় ২০১৯ সালে প্রকাশিত)
-ড. শাহ্ মোঃ আহসান হাবীব
‘মালিকানা’, ‘নেতৃত্ব’, ‘পরিচালন পদ্ধতি’, ‘সিদ্ধান্ত গ্রহনব্যবস্থা’ এবং ‘ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’ যে কোন প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা ও সফলতার সাথে সম্পর্কিত এবং অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। পাঠ্য বইয়ের ভাষা অনুসারে শেয়ার হোল্ডাররাই প্রকৃত মালিক এমনটি বলা হয়। এ তত্ত¡টি বাণিজ্যিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সত্য বলে মনে হয় না। মালিকানার সাথে মূলধনের সম্পৃক্ততা এবং ঝুঁকি গ্রহণ একান্তভাবে স¤পর্কিত। বাণিজ্যিক ব্যাংক যখন প্রথম স্থাপন করা হয়, তখন স্বল্প সংখ্যক উদ্যোক্তা তাঁদের পুঁঁজি বিনিয়োগের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে থাকেন এবং এ সংক্রান্ত ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকেন। ব্যাংকের আত্মপ্রকাশ একটি অর্থনীতিতে শরীরের রক্তনালীর সাথে একটি নতুন অঙ্গ যুক্ত করার শামিল। সংযুক্ত হবার সাথে সাথে অর্থনীতির এ অঙ্গে রক্তপ্রবাহ অথবা ব্যাংকে আমানতকারীর অর্থ প্রবাহ শুরু হয়। অর্থাৎ নতুন বিনিয়োগকারী ও ঝুঁকিগ্রহণকারীর সম্পৃক্ততা ঘটে ব্যাংকের সাথে। সাথে সাথে সমীকরণ পাল্টে যায় এবং আমানতকারীরা মালিকানা স্বত্ত¡ার বিচারে সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিক এ পরিণত হয়। আর উদ্যোক্তাগণ বা পর্ষদ সদস্যবৃন্দ হয়ে যান সংখ্যালঘিষ্ট মালিকচক্র। সুতরাং ব্যাংকের প্রকৃত মালিক বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকগণ আর কেউ নন, সামগ্রিকভাবে আমানতকারীবৃন্দ। আর তাই সঠিক বিবেচনায় একটি ব্যাংককে ব্যক্তি মালিকানা বা সরকারী মালিকানা নাম দেয়া যুক্তিযুক্ত মনে হয় না। ব্যাংক এর সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিক যদি সাধারণ আমানতকারীবৃন্দ হন, তাহলে যেকোন ব্যাংকের প্রকৃত মালিক রাষ্ট্র। আমানতকারীরা মূলত সরকারী বা বেসরকারী নন বরং দেশের সাধারণ নাগরিক। সেক্ষেত্রে ব্যাংকের ক্ষেত্রে ‘সরকারী’ বা ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন’ শব্দগুলোর থেকে ‘সরকারী খাতে পরিচালিত ব্যাংক’ এবং ‘ব্যক্তিখাতে পরিচালিত ব্যাংক’ নামগুলো অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়।
মালিকানার সাথে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। যেহেতু আমানতকারীদের অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকগণের স্বার্থ তাঁরা নিজেরা সরাসরি সংরক্ষণ করতে পারেনা, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্যাংকখাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দায়িত্ব থাকে আমানতকারীর অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকবৃন্দের স্বার্থ সংরক্ষণ। সংখ্যালঘু মালিক পক্ষ অর্থাৎ শেয়ার হোল্ডাররা পরিচালনা পর্ষদের অংশ হিসেবে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের সুযোগ পান, যেহেতু তাঁরাই সাধারণত সূচনাকারী উদ্যোক্তা এবং সর্বোচ্চ ঝুঁকি গ্রহণকারী। তবে এক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিক পক্ষের অর্থাৎ আমানতকারীবৃন্দের স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন এমনটাই আশা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে একটি ব্যাংকের দীর্ঘকালীন স্বার্থ সংরক্ষনমূলক উদ্যোগ, নিয়ন্ত্রিত ঝুঁকিগ্রহন এবং দক্ষ পরিচালনা স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষনে কাজ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রনে এবং তত্ত¡াবধানে পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বশীল আচরণ একটি ব্যাংকের টেকসই বিকাশে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।
“মালিক” শব্দটি একজন ব্যক্তি বা পক্ষকে এমন একটি বোধ প্রদান করে যা তাঁর বা তাঁদের সিদ্ধান্ত প্রণালী বা তাঁদের কার্যক্রমকে প্রভাবিত করতে পারে। এ থেকে অনাকাঙ্খিত অধিকারবোধ তৈরী হতে পারে বা একজন ব্যক্তি বা পক্ষকে স্বেচ্ছাচারী আচরণ করতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে। সরাকারি বা বেসরকারী, যে খাতেই একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালিত হোক না কেন, আমানতকারীর স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিই সবসময় মূল লক্ষ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। আর সেক্ষেত্রে আমানতকারীর স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব সামগ্রিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং পরিচালনা পর্ষদের। এ দুপক্ষের ব্যর্থতা বা দায়িত্বশীল আচরনের ব্যাত্যয় হলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার মাঝে অধিক ঝুঁকি নেয়ার প্রবৃত্তি জন্ম নিতে পারে এবং ব্যাংকের আর্থিক স্থিতি সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন যে, ব্যাংকিং খাতের আর্থিক দুর্দশা শুধু আমানতকারী বা শেয়ার হোল্ডারদের জন্য ক্ষতিকর নয় বরং ব্যাংক খাতের মন্দা অর্থনৈতিক মন্দার জন্ম দিয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করতে পারে। যুগে যুগে এমনটি প্রমানিত হয়েছে।
বাণিজ্যিক ব্যাংকিং খাত বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের ধারণা তত্তে¡র সাথে এক করে দেখার সুযোগ নাই। বাণিজ্যিক ব্যাংকিং খাতে ‘প্রিন্সিপাল এবং এজেন্ট তত্ত’¡ প্রযোজ্য যা সাধারণত অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একরকম নয়। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা বা পরিচালনা পদ্ধতিও অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের তুলনায় জটিল। সেক্ষেত্রে ব্যাংকারগণ প্রকৃতপক্ষে মালিকচক্রের (আমানতকারী ও উদ্যোক্তা) এজেন্ট বা প্রতিনিধি। এ ধরণের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মালিক পক্ষের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন বা সফলতা অর্জনের জন্য প্রতিনিধি তথা এজেন্টদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
“মালিকানা সংক্রান্ত বোধ” ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে। পরিচালনা পর্ষদের অতি মালিকানাবোধ কখনও কখনও তাঁদেরকে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যক্রমে অযাচিত হস্তক্ষেপ এ উৎসাহ দিতে পারে। সার্বিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তত্তা¡বধান ব্যবস্থার মধ্যে পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বশীল আচরণ আমানতকারীদের প্রকৃত স্বার্থ সংরক্ষণ করতে পারে। যা ব্যাংক সুশাসন এর মূল দিক। ব্যাংকের সুশাসন কাঠামোতে পরিচালনা পর্ষদকে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সাথে একটি দূরত্ব বজায় রেখে নিয়ন্ত্রিত আচরণ করতে হয়।
সার্বিকভাবে মালিকচক্রের (আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডার) প্রতিনিধি হিসেবে তাঁদের নির্ধারিত নীতি ও প্রণালীর বাস্তবায়ন করে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনী কাঠামো এবং কঠোর নিয়ন্ত্রনের মাঝে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা এ মালিকচক্রের স¦ার্থ সংরক্ষন এবং লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হবে এমনটি কাম্য। এক্ষেত্রেও মালিকানা সংক্রান্ত বিভ্রান্তি ব্যাংকারদের আচরণকে প্রভাবিত করতে পারে। একজন ব্যাংকার যদি তাঁর চাকুরীজীবনের প্রথম দিনই জানতে পারেন “ব্যাংকের শাখায় যে সাধারণ মানুষগুলো সারিবদ্ধভাবে প্রতিদিন টাকা জমা করতে আসেন বা টাকা উত্তোলন করতে আসেন তারাই প্রকৃতপক্ষে প্রতিষ্ঠানের মালিক, তখন তাঁদের সার্বিক আচরণ এবং সেবা প্রভাবিত হয়”। এ ধরণের বোধ ব্যাংকার তথা ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে বলে মনে করি।
ব্যাংকের পরিচালনা এবং ব্যবস্থাপনা কাঠামোতে ব্যাংকারবৃন্দের কার্যপ্রনালী এবং কর্মদক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানের দীর্ঘকালীন লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্ধারিত নীতি ও কৌশলের আওতায় ব্যাংক ব্যবস্থাপনা মালিকচক্রের স্বার্থ সংরক্ষন করার কথা। সেক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা বা ব্যাংকারবৃন্দ কার লক্ষ্য অর্জন বা স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করবে? প্রকৃতপক্ষে সংখ্যাগুরু মালিকপক্ষ হিসেবে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা তথা ব্যাংকাররা আমানতকারীদেরই প্রতিনিধি যদিও তারা মূলতঃ কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও পরিচালনা পর্ষদের নিয়ন্ত্রন ও নীতির মধ্যে ব্যাংক পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনা করে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইন ও তত্ত¡াবধান কাঠামো আমানতকারীদের স্বার্থকেন্দ্রিকই হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে পরিচালনা পর্ষদের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষনে সচেষ্ট হতে হয় ।
ব্যাংক পরিচালনায় কাঙ্খিত পরিবেশ তৈরী করতে ব্যাংকের শীর্ষ নেতৃত্বের ভূমিকা অনস্বীকার্য। ব্যাংকের শীর্ষ নেতৃত্বে কারা? পরিচালনা পর্ষদ নাকি ব্যাংক এর শীর্ষ ব্যবস্থাপনা? প্রকৃতপক্ষে পরিচালনা পর্ষদ বা একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনা এককভাবে একটি ব্যাংক পরিচালনা করতে পারে না। এটি তাঁদের একটি সমন্বিত নেতৃত্ব চক্র।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সুনির্দিষ্ট আইন ও তত্ত¡াবধান কাঠামোর মাঝেও পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতায় আমানতকারীদের স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। ব্যাংক ব্যবস্থাপনা এবং পরিচালনা পর্ষদ সার্বিকভাবে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে কাজ করলেও তাঁদের কাজের ক্ষেত্র বা সীমানা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আইনী কাঠামোর মাঝে নির্ধারিত থাকে। সাধারনভাবে ব্যাংকের দৈনন্দিন কার্যপ্রনালীতে পরিচালনা পর্ষদের সরাসরি নিয়ন্ত্রন বা ভূমিকা কাম্য নয়। ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সাথে পরিপূরক ও সহযোগিতামূলক আচরনের মাঝেও পরিচালনা পর্ষদের নিজস্ব কার্য সীমানা কঠোরভাবে পালন করার মাঝেই ব্যাংকের দীর্ঘকালীন সফলতা লুকায়িত। এ দুপক্ষের অর্থাৎ পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংক ব্যবস্থাপনার সমন্বয়হীনতাও ক্ষতিকর ফল বয়ে আনে। দুর্বল পরিচালনরা পর্ষদের সুযোগে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা স্বেচ্ছাচারী আচরন করতে পারে। সুতরাং ব্যাংক পরিচালনায় এ দুপক্ষের একান্ত সহযোগিতা এবং নিয়ন্ত্রিত আচরন অত্যন্ত জরুরী।
সার্বিকভাবে একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ ব্যবস্থাপনা হলো প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নেতৃত্বচক্র যারা নিজেদের মাঝে আইন ও আদর্শগত নির্ধারিত দূরত্ব বজায় রেখে সমন্বয়ের মাধ্যমে সফলভাবে ব্যাংক পরিচালনা করবে এবং আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট হবে- এমনটাই কাম্য।
লেখক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব্ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর অধ্যাপক ও পরিচালক প্রশিক্ষণ ।