ব্যাংকিং খাতে নেতৃত্বঃ নিয়ন্ত্রিত প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য

April 20, 2020
2132
Views

(বর্ণিক বার্তায় ২০১৯ সালে প্রকাশিত)

-ড. শাহ্ মোঃ আহসান হাবীব

প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য নির্ধারন এবং তার সাথে সঙ্গতিপূর্ন নীতি ও কৌশল প্রনয়ন পরিচালনা পর্ষদের মূল কার্যক্রমের অংশ। আর তার বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব অর্পন করা হয় ব্যাংক ব্যবস্থাপনার উপর। ব্যাংক ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম নির্ধারণ ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিচালনা পর্ষদের নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট। পরিচালনা পর্ষদের লক্ষ্য ও সিদ্ধান্ত ব্যাংক ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম ও ঝুকি প্রনালীকে প্রভাবিত করে তবে এক্ষেত্রে লক্ষ্য কৌশলের সময়কাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। স্বল্পকালীন লক্ষ্য এবং কৌশল নির্ধারণ অনেক ক্ষেত্রেই একটি ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের টেকসই বাণিজ্যিক প্রবৃদ্ধির অন্তরায় হতে পারে। আদর্শগতভাবে দীর্ঘকালীন লক্ষ্যকে সামনে রেখে এবং সময়োপযোগী কৌশল নিধারণের মাধ্যমে একটি ব্যাংকের শীর্ষ (পরিচালনা পর্ষদ ও ব্যাংক শীর্ষ ব্যবস্থাপনা) নেতত্ব চক্র প্রবৃদ্ধি অর্জনে কাজ করবে। দীর্ঘকালীন লক্ষ্যকে ভেঙ্গে স্বল্পকালীন লক্ষ্য নির্ধারণ করা যেতে পারে। এবং সময়ের সাথে সঙ্গতি রেখে কৌশলগত পরিবর্তন ও পরিমার্জন হতে পারে এমনকি দীর্ঘকালীন লক্ষ্যের ও যুক্তিপূর্ণ সমন্বয় হতে পারে।

স্বল্পকালীন লক্ষ্য ও কৌশল নির্ধারন ও বাস্তবায়নের যৌক্তিকতা এবং উৎসাহের কারন কি হতে পারে? একটি কারন হতে পারে, “পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনার মধ্যে নিজেদের অবস্থানকালীন সময়ে অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রচেষ্টা বা প্রবণতা” আপাত দৃষ্টিতে এর কোন ক্ষতিকর প্রভাব পরিলক্ষিত না হলেও প্রকৃতপক্ষে এধরনের প্রবনতা সার্বিক টেকসই প্রবৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। তবে দীর্ঘকালীন লক্ষ্যের অংশ হিসেবে যে কোন পরিচালনা পর্ষদ বা শীর্ষ ব্যবস্থাপনার স্বল্পকালীন লক্ষ্য ও কৌশল স্বাভাবিক ভাবেই যুক্তিপুর্ণ।

বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যিক পরিবেশে ব্যাংকগুলোতে সমসাময়িক মুনাফা ধরে রাখা কঠিন হচ্ছে। ব্যয় সংকোচন বা অধিক আয় এর জন্য কাজের ব্যাপ্তি বা পরিচালন আয় বাড়ানোর মাধ্যমে প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর সুযোগ হতে পারে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ব্যয় সংকোচন প্রায় অসম্ভব হয়ে দাড়িয়েছে। বিশেষত ২০০৮-২০০৯ এর বিশ্ব ও আর্থিক মন্দা পরবর্তী সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিপালন নীতির যে পরিবর্তন ঘটেছে তার ফলে ব্যাংকগুলোতে পরিচালন প্রক্রিয়ায় বহুলাংশে পরিবর্তন এসেছে এবং ব্যয় এর বোঝা উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। ব্যয়ের কারন মূলত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নতুন নতুন প্রতিবেদন উপস্থাপনার নির্দেশনা, এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ এবং প্রশিক্ষন ইত্যাদি যা থেকে ব্যাংকগুলোর দূরে থাকার কোন সুযোগ নেই। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকের পরিচালন ব্যয় বেড়ে চলেছে। এটি এখনকার সার্বজনীন প্রবনতা। একারনে প্রবৃদ্ধির বর্তমান অবস্থা ধরে রাখতেই ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে বিশ্বব্যাপী। এধরনের পরিস্থিতি ব্যাংক ব্যবস্থাপনার উপর নতুন চাপ প্রয়োগ করে চলেছে।

এক্ষেত্রে আর একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন হলো ব্যাংকিং খাতে অপরাধ প্রবণতার বৃদ্ধি যেখানে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ অনেক বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে।এর ফলশ্রæতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবং মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ সংস্থার মাধ্যমে সারা বিশ্বে ব্যাংকগুলোতে নজরদারী বাড়ানো হচ্ছে এবং আইন পরিপালন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া আরো দৃঢ় করা হচ্ছে। এ পরিবর্তিত পরিস্থিতির ফলেও ব্যাংকগুলোর পরিচালন ব্যয় বেড়েই চলেছে। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকিং ব্যবসা অব্যাহত রাখার জন্য এ মুহুর্তে এর কোন বিকল্প হয়তো নেই।

আর্থিক অনিয়ম যেমন মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব চক্রকে যথেষ্ট প্রেরণা দেয়া অত্যন্ত কঠিন। বিশেষত এ সংক্রান্ত ব্যয় পরিচালনা পর্ষদের দীর্ঘকালীন স্বার্থ তথা প্রতিষ্ঠানের স্বার্থের সাথে সম্পৃক্ত হলেও সাধারণত পরিচালনা পর্ষদ এ জাতীয ব্যয় খাতের সাথে সহমত পোষণ করতে প্রায়শঃই দ্বিধা করে থাকেন। এ ধরণের ব্যয় ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনার জন্যও নিরুৎসাহের কারণ হতে পারে। কারণ তার কোন দৃশ্যমান ফলাফল স্বল্পকালীন সময়ে দেখা যায় না বা প্রভাব সরাসরি চোখে পড়ে না। প্রায়শঃই মানি লন্ডারিং বিষয়ক ব্যবস্থাপনা ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংক নেতৃত্বের যথেষ্ট ইতিবাচক মনোভাব পরিলক্ষিত হয় না। এটি সারাবিশ্বেও ব্যাংকির খাতের একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বর্তমান সময়ে ব্যাংকিং পরিচালনা বিশেষত বৈদেশিক বাণিজ্যে সেবা প্রদান করতে হলে এ ধরণের ব্যয়ভার থেকে মুক্ত হবার সুযোগ নেই, বরং দীর্ঘকালীন পরিকল্পনার আওতায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিপালন নীতি অনুসরণের মাধ্যমেই এ সংক্রান্ত ঝুঁকি কমানো সম্ভব।

পরিবর্তিত প্রতিযোগিতা ও পরিপালন ব্যবস্থায় ব্যাংকিং খাতে মুনাফার হার অব্যাহত রাখা কঠিন হয়েছে। যথাযথ দুরদর্শিতার অভাবে বিশ্বের অনেক বড় বড় ব্যাংকও এ পরিস্থিতিতে ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে এবং হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রেই এ অবস্থা মোকাবিলায় নেতৃত্ব চক্রের দূরদর্শিতা ও গর্ভন্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে। হঠাৎ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যের উপর চাপ না বাড়িয়ে তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক সেবার প্রচলন ও আধুনিকায়ন ব্যাংকিং খাতের জন্য লাভজনক কৌশল প্রমাণিত হয়েছে। এ ধরণের বড় পরিবর্তন ও পরিবর্ধন স্বল্পকালীন প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যকে ব্যাহত করেছে স্বাভাবিক ভাবেই, তবে দীর্ঘকালীন ও টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের পথে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রেখেছে এবং রাখছে। বিশেষত তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক পরিবর্তন ব্যয় সাপেক্ষ ও প্রকৃত ফলাফল সময়সাপেক্ষ। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তা পরিচালনা পর্ষদের কাছে আকর্ষণীয় হয় না। তবে প্রকৃত ও সুযোগ্য নেতৃত্বচক্র এহেন দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই একটি বাংকের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করবেন-এটাই কাম্য ।

অধিক পরিচালন ব্যয়ভার এবং টেকসই প্রবৃদ্ধির ভিত্তিস্থাপন ব্যাংকের শীর্ষ ব্যবস্থাপনার জন্য নিরুৎসাহমূলক হতে পারে। এর ফলে স্বল্পকালীন প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য ব্যাহত হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে কোন কোন দৃশ্যমান পরিবর্তন/ ফলাফল পরিলক্ষিত হয় না। অবশ্যই এধরণের অনেক পদক্ষেপ ব্যাংকের টেসকই প্রবৃদ্ধির জন্য কাঙ্খিত, কখনো কখনো অতি জরুরী। সেক্ষেত্রে শুধুমাত্র প্রবৃদ্ধি হার দিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার দক্ষতাকে বিচার করার সুয়োগ নাই। বরং শীর্ষ ব্যবস্থাপনার কর্মদক্ষতা কতটা টেকসই প্রবৃদ্ধির ভিত্তি তৈরী করছে তা অবশ্যই বিচার্য। তবে শীর্ষ ব্যবস্থাপনার কর্মপদ্ধতি ও কৌশল বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া বহুলাংশে পরিচালনা পর্ষদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং আর্থিক বা অন্যান্য প্রেরণার উপর নির্ভর করে থাকে। পরিচালনা পর্ষদে দীর্ঘকালীন লক্ষ্য ও সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি যথাযথ পথ নির্দেশনা দিয়ে থাকে।

যুক্তিপূর্ণ প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য নির্ধারণ একটি ব্যাংকের নেতৃত্বের অন্যতম মূল কাজ যা প্রতিষ্ঠানের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। প্রবৃদ্ধি সংক্রান্ত উচ্চাকাঙ্খা পরিচালনা পর্ষদের স্বল্পকালীন লক্ষ্য অর্জনে সহয়তা করতে পারে। তবে সার্বিকভাবে দীর্ঘকালীন টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের মূল বাঁধা হয়ে দাড়ায়। এমনকি ব্যাংক ধ্বংসের মুখোমুখি হতে পারে এর ফলে। সর্বশেষ (২০০৭-১২) বিশ্ব আর্থিক মন্দার মূল কারণ হিসেবে প্রবৃদ্ধির অতি উচ্চআকাঙ্খাকেই দায়ী করা হয়ে থাকে। এ ধরণের অতি প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য ব্যাংক এর ব্যবস্থাপনাকে অতিরিক্ত ঝুঁকি নিতে বাধ্য করে। এক্ষেত্রে অধিক মুনাফা ব্যাংক ব্যবস্থাপনাকে বোনাস ও অন্যান্য আর্থিক সুবিধার জন্য প্রলুব্ধ করে থাকে। অধিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্য অর্জনে ব্যাংক নেতৃত্ব চক্রের উচ্চকাঙ্খা ব্যাংকের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। অধিক মুনাফা লক্ষ্য মানে ব্যাংক বা ব্যাংকের শাখার জন্য অধিক মুনাফা লক্ষ্য, অর্থাৎ অধিক ঋণ প্রদানে অতি আগ্রহ। এর ফলে ঋণ ঝুঁকি কার্যক্রমে শিথিলতা বা এর সাথে আপোষ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায় । ফলাফল হতে পারে যথাযথ ঝুঁকি ব্যস্থাপনার প্রয়োগের অভাবে মন্দ ঋনের এর পরিমাণ বৃদ্ধি যা ব্যাংকের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ। কার অর্থ ব্যবহার করে এমন উচ্চাকাঙ্খী মুনাফা অর্জনের প্রচেষ্টা? কেন অত্যাধিক ঝুঁকি গ্রহণের প্রবণতা? এ প্রবনতা একটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনাকে সম্পূর্ন অকেজো করে ফেলতে পারে যা সার্বিকভাবে মালিকচক্রের (আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডার) জন্য ক্ষতিকর ও অর্থনীতির জন্য ধ্বংসাত্বক প্রভাব বয়ে আনতে পারে। প্রকৃতপক্ষে, যুক্তিপূর্ণ মুনাফা বা প্রবৃদ্ধি নির্র্ধারণ সংক্রান্ত দূরদর্শিতা ব্যাংকের টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিতের সাথে সাথে যথাযথ ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার ব্যবহার ও প্রয়োগের জন্য অত্যন্ত জরুরী। বোধহয় নেতৃত্ব চক্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গুণ এটাই যা বর্তমান বিশ্বের ব্যাংকিং খাতকে সংহত করতে সবচেয়ে বেশী সহায়ক।

লেখক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব্ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর অধ্যাপক ও পরিচালক প্রশিক্ষণ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *