ব্যাংকিং খাতে নেতৃত্বঃ দায়িত্ব এবং অধিকারবোধ

April 20, 2020
2735
Views

(বর্ণিক বার্তায় ২০১৯ সালে প্রকাশিত)

-ড. শাহ্ মোঃ আহসান হাবীব

ব্যাংক ব্যাবস্থাপনা বা ব্যাংকাররা মালিকচক্রের (আমানতকারী ও শেয়ারহোল্ডার) এজেন্ট বা প্রতিনিধি। প্রতিনিধি বা এজেন্টদের মাধ্যমে প্রকৃত মালিকের নীতির বাস্তবায়ন ও লক্ষ্য অর্জন বেশ কিছু বিষয়ের উপর নির্ভর করে এবং এর সফলতার পেছনে অন্যান্য অংশীদারী পক্ষেরও ভূমিকার প্রয়োজন হয়। এজেন্ট বা প্রতিনিধির মাঝে একেবারে প্রকৃত মালিকের ন্যায় দায়িত্বশীল আচরন এবং অধিকারবোধের প্রয়োগ সহজসাধ্য নয়। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড এবং সামাজিক আচরনবিধির পর্যালোচনা করলে সহজেই তা সবার চোখে ধরা পড়তে পারে।

“উত্তরাঞ্চলের একটি ছোট্ট শহরের এক ক্রেতা রাত দশটার দিকে পাড়ার দোকানের উদ্দেশ্যে একটি স্বল্প মূল্যের সাধারন পন্য কিনতে বের হলেন। ভাবছিলেন দোকানগুলো বোধহয় বন্ধ হয়ে গেছে। সাধারণত হয়ে যায়। দেখলেন আসলেও বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখলেন এক দোকানদার দোকান বন্ধ করে রিক্সায় উঠেছেন মাত্র। ক্রেতা তাকে অনুরোধ করলেন পন্যটি দেয়া যায় কিনা! দোকানদার রিক্সা থেকে নেমে দোকান খুলে (যা সময় সাপেক্ষ) শুধুমাত্র ৫ টাকার পন্যটি বিক্রয় করলেন। কেন? এটি কি শুধুমাত্র একটি মানবিক আচরন নাকি দীর্ঘকালীন ব্যবসায়িক আচরনের সাথে সম্পর্কিত? ঐ দোকানদার আসলে দোকানের মালিক এবং তাঁর আচরণকে তিনি প্রতিষ্ঠানের বাণিজ্যিক স্বার্থের সাথে সম্পৃক্ত করতে পেরেছেন যা তার নিজের স্বার্থের থেকে আলাদা নয়।

দ্বিতীয় দিন একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো অন্য একটি একই ধরনের পন্যের দোকানে। “দোকানদার দোকানটা বন্ধ করছিলেন মাত্র। কিন্তু আজ ক্রেতার অনুরোধে দোকানদার জানালেন ১০ টার পরে বিক্রয় বন্ধ। কাল আসবেন। ক্রেতা অবাক হলেন না বরং দোকান মালিক না থাকলে এমনটিই হয় ভেবে বিষয়টি মেনে নিলেন”

তৃতীয় দিন এমন ঘটনার হুবহু পুনরাবৃৃত্তি ঘটলো – শুধুমাত্র পন্যের দোকান এবং দোকানদার ভিন্ন। “ক্রেতা অনুরোধ করতেই দোকানদার রিক্সা থেকে নেমে দোকান খুলে ৫ টাকার পন্যটি বিক্রয় করলেন। ক্রেতা ভেবেছিলেন, দোকানের মালিক হবেন। কিন্তু অবাক ব্যাপার, তিনি দোকানের কর্মচারী। তবে আচরণে দোকানের প্রতি অধিকার এবং দায়িত্ববোধ স্পষ্ট। অবশ্যই কোন না কোন প্রেরণার উৎস থেকে কর্মচারীটির মাঝে এহেন অধিকার ও দায়িত্ববোধ এর জন্ম হয়েছে যা তার আচরণকে প্রভাবিত করেছে”। অর্থাৎ এজেন্ট বা প্রতিনিধি কখনো প্রিন্সিপাল হয় না তবে তাঁর/ তাঁদের মতো অধিকার আর দায়িত্ববোধ প্রদর্শন করতে পারে/ পারেন।

একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালনায় ব্যাংকারদের মাঝে এহেন অধিকার ও দায়িত্ববোধ এর বিকাশ এর বিকল্প নাই। ব্যাংকের প্রতি ‘অধিকারবোধ’ (ঋববষরহম ড়ভ ঙহিবৎংযরঢ়) একটি অত্যন্ত জরুরী নেতৃত্বগুণ যা থেকে দায়িত্ববোধের জন্ম হয় এবং ব্যাংকার তথা ব্যাংক ব্যবস্থাপনা আমানতকারী এবং উদ্যোক্তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে সচেষ্ট হয়। একজন ব্যাংক ম্যানেজারের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত আচরণ তাঁর দায়িত্ব ও অধিকার বোধকে সজ্ঞায়িত করতে পারে। আমার দুটি তহবিল ব্যবস্থাপনার উদাহরন সেক্ষেত্রে তুলনীয় হতে পারে।

“আমি দুটি ১০ লক্ষ টাকার অর্থ তহবিল এর দেখভাল করছে যা আমার আয়ের একটি উৎস। প্রথম তহবিলটা সম্পূর্ণ আমার। কিন্ত দ্বিতীয় তহবিলটা আমার বন্ধুর অর্থ। পরিচালনাকারী হিসেবে লভ্যাংশ সমান ভাবে বন্টন হয়ে থাকে। হঠাৎ একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের সুযোগ পেলাম। তবে সময় অনুকুলে থাকলে লাভ দ্বিগুণ বা তিনগুণ হতে পারে। কোন তহবিলটি ব্যবহার করবো? বন্ধুর অর্থ এই ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগে ব্যবহার করলে যদি পুঁজি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে আমার সিদ্ধান্ত তার কাছে কি গ্রহণযোগ্য হবে? হয়তোবা না । বন্ধুর অর্থে এমন ঝুঁকি নেয়া ঠিক হবে না। সুতরাং নিজের অর্থ বিনিয়োগ করলাম”। এটাই বোধহয় দায়িত্বশীল আচরণ হবার কথা। যদি বন্ধুকে বোঝানো না যায় তবে আমানতকারী আপনার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত বা অযৌক্তিক ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রমকে স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করার কোন যৌক্তিকতা নাই। বরং আমানতকারীর অর্থ ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ব্যবহারে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন।

‘অধিকারবোধ’ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে মূল সিদ্ধানÍ গ্রহন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। ঋণ গ্রহীতা নির্বাচন এবং ঋণ পরিশোধ ব্যাবস্থপনা ব্যাংকিং কার্যক্রমের অত্যন্ত জরুরী উপাদান। ভুল ঋণগ্রহীতা নির্বাচন ঋনের গুনগত মানকে ক্ষুন্ন করে এবং ঋণ পরিশোধ কার্যক্রম ব্যাহত হয়। এক্ষেত্রে ব্যর্থতার ফলে একটি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধও হয়ে যেতে পারে যা মালিকচক্র এবং অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে মালিক এবং প্রতিনিধি হিসেবে আচরনের ভিন্নতা হওয়া অযৌক্তিক নয়।

“একজন ব্যাংক ম্যানেজার তার প্রতিবেশীকে ৫ লক্ষ টাকা ঋণ দিয়েছেন, এ মাসেই যার লভ্যাংশ ও একটি কিস্তি শোধ করে দেয়ার কথা। অন্য এক ভাগ্যবান প্রতিবেশী অবশ্য ম্যানেজারের মাধ্যমে ব্যাংক থেকেই ৫ লক্ষ টাকার ঋণ পেয়েছেন। ১০ শতাংশ সুদে। দুজনই সময়মত ঋণ পরিশোধ করছেন না বা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ব্যাংক ম্যানেজারের আচরণ দুই ক্ষেত্রে কি এক রকম? একরকম আচরন হওয়াটা আদর্শগতভাবে সঠিক। কিন্তু এমনটি হওয়া সহজ নয়। কারণ প্রিন্সিপাল এবং এজেন্ট এর আচরণ এক হবার কথা নয়। প্রিন্সিপাল হিসেবে ম্যানেজার সাহেব কোন সীমা মানছেন না এবং সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রতিবেশীর কাছ থেকে ৫ লক্ষ টাকা আদায় করার জন্য । ইতোমধ্যে তাদের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে। কারণ এতে ম্যানজার সাহেবের স্বার্থ ক্ষুন্ন হয়েছে, অত্যন্ত স্বাভাবিক আচরণ। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে আইনী কাঠামোর মাঝে অর্থ আদায়ের চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে একই রকম প্রচেষ্টার আগ্রহ অনুভব করছেন না ম্যানেজার সাহেব । ব্যাংকের স্বার্থ ঠিক নিজের স্বার্থ হয়ে ম্যানেজার সাহেবের আচরণকে প্রভাবিত করছে না”। বিষযটি সব ক্ষেত্রে হয়তো এক রকম নয়। আর এজেন্ট একবারে প্রিন্সিপাল হতে পারে না তবে এজেন্ট প্রিন্সিপালের কাছাকাছি যেতে পারে আচরণের দিক থেকে। আর এহেন দায়িত্বশীল আচরণের জন্ম হয় অধিকারবোধ থেকে। ব্যাংকের তহবিল সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনায় অধিকারবোধ ব্যাংকারদের অত্যন্ত জরুরী একটি নেতৃত্বগুণ এবং প্রতিষ্ঠানের সাফল্যের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। তবে এধরনের নেতৃত্বের বিকাশ ও অনুকুল পরিবেশ তৈরীতে ব্যাংক ব্যবস্থাপনা তথা ব্যাংকারদের যথেষ্ট আইনী, সামাজিক ও আর্থিক প্রেরণা নিশ্চিত করার প্রয়োজন আছে। এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের সকল অংশীদারী পক্ষের ভূমিকা একান্ত কাম্য।

প্রকৃতপক্ষে, একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ প্রদানের পর সাার্বিক সহযোগিতা প্রদানের পাশাপাশি ঋণগ্রহনকারীর উপর তিন ধরনের চাপ প্রয়োগ করার প্রয়োজন হয়। প্রথমত, প্রাতিষ্ঠনিক দ্বিতীয়ত, আইনী তৃতীয়ত সামাজিক। ব্যাংকারদের মাঝে প্রাতিষ্ঠানিক অধিকারবোধ তাঁদেরকে মালিকের ন্যায় আচরনে সচেষ্ট করে এবং ঋণ পরিশোধে প্রয়োজনীয় চাপ অব্যাহত রাখতে উৎসাহিত করে। তবে ঋনগ্রহীতা নির্বাচনে ব্যাংকারদের যে দায়িত্বপালন করতে হয় সেক্ষেত্রে শতভাগ সাফল্য আশা করা যায় না। যেকোন ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋনগ্রহীতা নির্বাচনে ভুল হতে পারে অবশ্যই স্বল্প পরিসরে। সেক্ষেত্রে সবসময় তা ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় না। আইনের যথেষ্ট প্রয়োগ থাকলে ব্যাংকের জন্য এধরনের সমস্যা কাটিয়ে ওঠা কঠিন নয়। আইন প্রয়োগের দুর্বলতা শুধুমাত্র ভুল ঋনগ্রহীতাকে ঋন ফেরত না দিতে উৎসাহিত করে না, বরং অনেক ক্ষেত্রে ভালো ঋনগ্রহীতাকে ঋন ফেরত দিতে নিরুৎসাহিত করতে পারে।

ঋনগ্রহীতার মাঝে অবশ্যই আইনের প্রতি প্রয়োজনীয় শ্রদ্ধা ও ভীতির প্রয়োজন আছে। “ঋন পরিশোধ না করলেও আইনের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়” -এমন বোধ ইচ্ছাকৃত ঋনখেলাপীদের উৎসাহিত করে এবং ব্যাংকে ঋন কার্যক্রম এর দক্ষতার উপর প্রভাব ফেলে। সুতরাং আইনের যথেষ্ট প্রয়োগের বিকল্প নেই। “ইচ্ছাকৃত ঋনখেলাপী এবং অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে যে সমস্ত ঋনগ্রহীতা ঋন ফেরত দিতে পারেন না- এ দু পক্ষকে একভাবে দেখার সুযোগ নেই । তাৎক্ষনিকভাবে যারা যুক্তিযুক্ত কারনে ঋন ফেরৎ দিতে পারছেন না তাঁদের যেমন সহযোগীতার প্রয়োজন আছে, যারা ইচ্ছাকৃত ঋন ফেরৎ দেন না তাদের বিরূদ্ধে সহজে আইনি ব্যবস্থা নেয়া যায় এমন পরিবেশ ও ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। সামাজিক চাপ ইচ্ছাকৃত ঋন খেলাপীদের সামাজিকভাবে হেনস্তা করার পরিবেশ তৈরি করে যার ফলে ব্যাংকের ঋন আদায় সহজতর হয়। ব্যাংকারদের নেতৃত্বগুনের বিকাশে ও তাঁর সুষ্ঠু ব্যবহারের জন্য এধরনের আইনি ও সামাজিক সহযোগীতা অত্যন্ত জরুরী।

লেখক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব্ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর অধ্যাপক ও পরিচালক প্রশিক্ষণ ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *