অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমস্যা সমাধানে প্রায়োগিক গবেষণা

April 3, 2021
3251
Views

-ডঃ শাহ্‌ মোঃ আহসান হাবীব

গবেষণা একটি লক্ষ্য এবং পদ্ধতিভিত্তিক কার্যক্রম যা সামগ্রিক বা ক্ষেত্র বিশেষের উন্নয়ন এবং সমস্যা সমাধানে কাঙ্খিত ভূমিকা রাখতে পারে।  কোন  বিষয়ের  অন্তর্নিহিত সমস্যার গভীরে আলোকপাত করে পরবর্তী করনীয় নির্ধারণ করতে পারে একটি  গবেষণা। সেক্ষত্রে   প্রত্যেক গবেষণা কাজের   একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য থাকে। আর যখন নিয়মন্তান্ত্রিক ভাবে বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে সে লক্ষ্য অর্জনে একজন গবেষক সচেষ্ট হন, তাকেই নাম দেয়া হয়েছে ‘গবেষণা’। অর্থনৈতিক গবেষণা কর্মের সফলতা এবং গ্রহণ যোগ্যতা সর্বজনবিদিত। গবেষণা কি শুধুমাত্র প্রকাশনার জন্য করছি নাকি কোন বাস্তবধর্মী সমস্যা বা বিষয় কে লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিচ্ছি? অবশ্যই ভালো জার্নাল বা  গবেষণা প্রকাশনার গুরুত্ব সর্বজনস্বীকৃত।  তবে অর্থনৈতিক   গবেষণাকে কতটা প্রায়োগিক করতে পারছি আমরা? অর্থনীতি তথা শিল্প বানিজ্যের সমস্যা সমাধানে কতটা ব্যবহার করতে পারছি গবেষণা কর্মকে? আমাদের গবেষণা কতটা অবদান রাখতে পারছে বাস্তব ভিত্তিক অর্থনৈতিক কর্ম সম্পাদনের বা উন্নয়নের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে? এসব প্রশ্নের অবতারণার উদ্দেশ্য, অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রের সমস্যা সমাধানে গবেষণাকে প্রাধান্য দেয়া এবং প্রায়োগিক গবেষণা পন্থা নিয়ে আলোচনা করা ।  

শিক্ষাভিত্তিক গবেষণা এবং এর প্রকাশনা একজন গবেষকের পরিপক্কতা আনার  জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ ।  বলা যায় একটি  নির্দিষ্ট বা “প্রেসস্ক্রাইব ফরম্যাটে” গবেষণা কাজ সম্পন্ন করতে হয় বিধায়  মৌলিক গবেষণা কাজ শেখা বা বোঝার জন্য একাডেমিক গবেষণার কোন বিকল্প নেই। তবে বোধহয় গবেষণা কাজের চূড়ান্ত বা পরিপূর্ণ একটি রূপ হল প্রায়োগিক গবেষণা, যার মাধ্যমে একজন গবেষক গবেষণা পদ্ধতির প্রয়োজনীয় ব্যবহার করে তার গবেষণালব্ধ ফলাফলের মাধ্যমে মানবকল্যাণে অবদান রাখতে সচেষ্ট হন। আর বোধহয় তখনি গবেষণাকর্ম   আপাতদৃষ্টিতে একটি নিরস, শ্রমলব্ধ বিষয় থেকে পরম ভালবাসার ক্ষেত্রে পরিণত হয়।

প্রায়োগিক গবেষণা কাজের ধরনটা একটু আলাদা মনেকরি। এ ধরণের  গবেষণা  কাজ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিষয় নির্বাচনে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয়। বলা যায় গবেষককে এক্ষেত্রে দূরদর্শী হতে হয়। গবেষণার লক্ষ্য নির্ধারণ অর্থাৎ কাদের জন্য এই  গবেষণা, এর উপকার বা সুবিধাভোগী  কারা হবেন অর্থাৎ কারা এর মাধ্যমে উপকৃত হবেন সেটা অনুমিত ও বোধগম্য হওয়াটা অত্যন্ত জরুরী।  সে দিক থেকে বলতে গেলে একজন গবেষক শুধু নিজের কর্মপরিধি বাড়ানোর জন্যই  এধরণের  গবেষণা করেন না। গবেষণার ফলাফল উক্ত বিষয়ের উন্নয়নে সর্বোপরি সামগ্রিকভাবে কতোটা জনকল্যাণে প্রভাব রাখতে পারবে সেটাই গুরুত্ব পাবার কথা। গবেষণার এ পরিপ্রেক্ষিত  বা পন্থাকে একজন গবেষকের সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবেও দেখা যেতে পারে।

আমরা জানি যে, গবেষণা পরিচালনার মূল উপাদান তথ্য উপাত্ত। কোন বিষয়ে তথ্য উপস্থাপন মানেই গবেষণা নয় সেকথাও জানা। সংগৃহীত তথ্য যতক্ষণ একটি নির্ধারিত পন্থা অনুসরণ করে  বিশ্লেষণ ও উপস্থাপন করা না হবে, ততক্ষণ এটিকে গবেষণা বলা যাবে না। গবেষণা পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বা বলা যায় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হয়। বিশেষত  অ্যাকাডেমিক গবেষণায় মূল্যায়নের মাপকাঠি হিসেবে মূলতঃ বিবেচিত হয় ‘গবেষণা পদ্ধতি’।  তবে প্রায়োগিক   গবেষণার ক্ষেত্রে যে বিষয়টাকে সবচেয়ে  বেশী গুরুত্ব দিতে হবে সেটা হল গবেষণার যে উদ্দেশ্য তা  পূরণ  হচ্ছে কি না?  বিশদ আকারে বলতে গেলে যে বিষয়ে গবেষণা করা  হচ্ছে বা হয়েছে সে বিষয়ে বাস্তবভিত্তিক যে সব সমস্যা রয়েছে, তার প্রতিফলন গবেষণা কাজে রয়েছে কিনা? গবেষণা থেকে  উক্ত বিষয়ের  যে প্রকৃত  চিত্র  আমরা জানতে চাই তা বেরিয়ে এসেছে কিনা?  এটা অত্যন্ত   জরুরি। এটাই প্রায়োগিক গবেষণার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য। কোন একটি গবেষণা কাজ নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনেই সম্পন্ন করা হয়েছে, অর্থাৎ প্রশ্ন প্রনয়ন, তথ্য বিশ্লেষণ ও সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ সবই করা হয়েছে, কিন্তু গবেষণার উদ্দেশ্য পূরণ হয়নি, তাকে  শুধুমাত্র গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি ব্যবহারের মাপকাঠিতে কোনভাবেই একটি সফল প্রায়োগিক  গবেষণাকর্ম বলা যাবে না।

বরং ক্ষেত্রে বিশেষে প্রায়োগিক গবেষণা পরিচালনায়, নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরন করার থেকেও গবেষণার লক্ষ্য বা উদ্দেশ্যের উপর বেশি গুরুত্ব দেয়ার প্রয়োজন হয়। অনেক সময় গবেষণার ফলাফলে প্রকৃত চিত্র তুলে আনতে গিয়ে নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণের ক্ষেত্রে কিছুটা নমনীয় অবস্থান নিতে হতে পারে গবেষককে। এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে গবেষণা পদ্ধতির ব্যবহার অযথা  শ্রম এবং সময় দুইয়ের অপচয়ের কারন হতে পারে। সমস্যা সমাধানে ভাল ফল পাওয়ার জন্য একটি  প্রায়োগিক গবেষণায়  গতানুগতিক গবেষণা পদ্ধতির সাথে আপসও হতে পারে। মুল কথা, গবেষকের  উদার দৃষ্টিভঙ্গি গতানুগতিক  গবেষণা পদ্ধতি না মেনেও সফলতার সাথে সমস্য সমাধান করলে সে কাজের মানের বিচার ফলাফল বা উদ্দেশ্য অর্জনের ভিত্তিতে হওয়া উচিৎ।  সেক্ষেত্রে, প্রায়োগিক  গবেষণা মূল্যায়নে, গবেষকের  দৃষ্টিভঙ্গি  ভিন্ন হবার প্রয়োজন আছে। অর্থাৎ, গবেষণার প্রকৃত উদ্দেশ্য অর্জনের জন্য অনেক সময় মুল্যায়নকারীকেও নমনীয়  মনোভাবাপন্ন  হওয়ার প্রয়োজন হয়।

এছাড়া বিশেষ ও জরুরী সময়ের গবেষণায় পদ্ধতিগত বিষয় সর্বাধিক গুরুত্ব পাবার সুযোগ নেই। উদাহরন হিসেবে বলা যায়, অর্থনীতিতে করোনা মহামারির সমস্যা  ও প্রভাব নিয়ে গবেষণা করতে গেলে আমরা যদি সঠিক নিয়ম মেনে তথ্য উপাত্ত খুঁজে দীর্ঘসময় নিয়ে গবেষণা করি তাহলে সেটা আমাদের কতোটা কাজে আসত!  সারা  বিশ্ব যখন এই মহামারির কারনে কার্যত বন্দি ছিল,  তখন আমরা এর মধ্যে যেটুকু বা  যতটুকু তথ্য পেয়েছি, তা দিয়েই কাজ করতে হয়েছে। কারন গবেষণা বা তথ্য বিশ্লেষণ  থেকে যে চিত্র বেরিয়ে এসেছে, তার আলোকে আমাদের পরবর্তী করনীয় নির্ধারণ করতে হয়েছে এবং এই  দুঃসময়ে সেটাই জরুরি ছিল। এ ধরণের পরিস্থিতিতে গবেষণার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রিতা সমস্যা থেকে উত্তরণের প্রক্রিয়াকে শ্লথ করে মাত্র। মনে রাখতে হবে সমস্যার ভয়াবহতা দেখে নির্ধারণ করতে হবে কোনটির উপর  কখন, কতখানি  গুরুত্ব  দেয়া প্রয়োজন। আর এ রকম পরিস্থিতিতেই গবেষকের মুন্সিয়ানা বা কাজের পরিপক্কতা দেখানোর সুযোগ ঘটে।

এমনটি ভাবার কোন কারন নেই যে, প্রায়োগিক গবেষণার  ক্ষেত্রে মৌলিক প্রক্রিয়া অনুসরণের প্রয়োজন পড়ে না। যথাযথ পদ্ধতি অনুসরনের মাধ্যমেই গবেষণা কর্ম সম্পাদন করতে হয়।  প্রায়োগিক গবেষণায় সমস্যা বা উদ্দেশ্যেকে  সর্বাধিক প্রাধান্য দেবার প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরার জন্যই মূলতঃ  এ ধরণের আলোচনার অবতারণা করা হয়েছে।

প্রায়োগিক গবেষণা গবেষকদের সাথে পেশাজীবী মানুষের সংযোগ সেতু তৈরি করে। গবেষকরা অর্থনীতি এবং এর বিভিন্ন ক্ষেত্রের সমস্যা গুলো অনুধাবন করতে পারেন এবং গবেষণার বিষয় নির্ধারণে সত্যিকারের সমস্যা গুলোকে বেছে নিতে পারেন। শিল্প, বানিজ্যে সম্পৃক্ত পেশাজীবীরা সেক্ষেত্রে গবেষণাকে কাজে লাগানোর সুযোগ পান, মূল্যায়ন করেন এবং এ উদ্দেশ্যে অর্থ বা সম্পদ বরাদ্দ্যের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। যার ফলে একদিকে যেমন বাস্তবভিত্তিক গবেষণার প্রসার ঘটে অন্যদিকে সমস্যা সমাধান তরান্বিত হয়। এছাড়া  বাস্তব ভিত্তিক গবেষণা বিভিন্ন শিল্প বানিজ্যে সক্ষমতা বৃদ্ধিতে আমূল পরিবর্তন আনতে পারে ।

সঠিক উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য  নির্ধারণের সাথে সাথে, প্রায়োগিক গবেষণা কর্ম সম্পাদনে কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখার প্রয়োজন আছে। যেহেতু প্রায়োগিক গবেষণার ব্যবহারকারী মূলতঃ পেশাজীবী বা নীতি নির্ধারক বা এমন শ্রেণী যারা গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে খুব বেশি পরিচিত নন, গবেষণার সহজ উপস্থাপনা অত্যন্ত জরুরী। এ ধরনের গবেষণা কাজে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের সাথে সম্পর্কিত পেশাজীবী বা নীতি নির্ধারক সরাসরি অংশ নিতে পারেন যা গবেষকের জন্য বারতি   আত্মবিশ্বাসের কারন হতে পারে। তথ্যের বৈধতা নিরূপণেও বড় অবদান রাখেন সরাসরি ক্ষেত্র সংশ্লিষ্ট পেশাজীবীরা ।  যেমন একটি ব্যাংক পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রায়োগিক গবেষণায়, গবেষক দলে পেশাজীবী গবেষকের সাথে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের ব্যাংক কর্মকর্তা  এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্মকর্তার উপস্থিতি বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করি ।  গবেষকরা অবশ্যই পদ্ধতিগত ভাবে  বিশেষ শিল্প-বানিজ্যে সংশ্লিষ্ট অংশীদারিপক্ষকে গবেষণার আওতায় আনেন। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে যেমন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থাপনা ও কর্মকাণ্ড পরিচালনা সংক্রান্ত গবেষণায় সংশ্লিষ্ট খাতের একজন পেশাজীবী যেভাবে সমস্যা ও বাস্তবতাকে অনুধাবন করবেন তা একজন পেশাজীবী গবেষকের জন্য সহজ নাও হতে পারে। সংশ্লিষ্ট খাতের পেশাজীবীর হয়ত  গবেষণা পদ্ধতি, তথ্য বিশ্লেষণ এবং উপস্থাপনা বিষয়ে পারদর্শিতা নেই, তবে গবেষণা দলে তার অন্তর্ভুক্তি প্রায়োগিক গবেষণাকে অনেক বাস্তবভিত্তিক এবং গ্রহণযোগ্য করে তুলতে পারে। গবেষণা হতে পারে সত্যিকারের প্রায়োগিক। 

গবেষণা পদ্ধতি সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান এবং পরিপক্কতা অর্জনের পরই প্রায়োগিক গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত করা শ্রেয়। একজন পরিপক্ক গবেষক বোধহয় প্রকাশনার থেকেও বেশি আনন্দ বোধ করেন বা সফল হন তখনিই যখন তাঁর গবেষণা কর্ম  বা গবেষণা  লব্ধ ফলাফল গবেষক ছাড়াও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রের পেশাজীবী বা কর্মজীবী বা সাধারন মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় বা ব্যবহারযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয়; যে বাস্তবভিত্তিক গবেষণা পরিচালিত হয় কোন বিশেষ ইতিবাচক উদ্দেশ্যে এবং কোন বিশেষ ক্ষেত্র বা জনবর্গকে লক্ষ্য করে, এবং যার ব্যবহার ও প্রয়োগযোগ্যতা দৃশ্যমান।   

লেখক বাংলাদেশ ইন্সিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট এর অধ্যাপক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *