আর্থিক খাতে নৈতিক অগ্রযাত্রায় যোগ্য জনবল পদায়ন প্রয়োজন

December 14, 2025
5
Views

বাংলাদেশের আর্থিক খাত আজ এমন এক পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে নেতৃত্বের মানই ভবিষ্যতের স্থিতি, সুশাসন ও টেকসই উন্নয়নের প্রধান নির্ধারক। যেকোনো দেশের ব্যাংক ব্যবস্থার শক্তি নির্ভর করে সেই ব্যক্তিদের দক্ষতা, সততা ও বিচক্ষণতার ওপর, যারা এই ব্যবস্থাকে পরিচালনা করেন। অর্থনীতি দ্রুত বিস্তৃত হওয়ায় ব্যাংক কার্যক্রমও ক্রমশ জটিল হয়ে উঠছে, ফলে ব্যাংকগুলোর সামনে দ্বৈত দায়িত্ব তৈরি হয়েছে-ব্যবসায়িক লক্ষ্য অর্জন করা এবং একই সঙ্গে কঠোর নৈতিক মানদণ্ড, সুশাসন ও দৃঢ় নিয়ন্ত্রক কাঠামোর প্রতি পূর্ণ প্রতিশ্রুতি বজায় রাখা। শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এমন নেতৃত্ব প্রয়োজন, যারা দায়িত্বশীলভাবে প্রবৃদ্ধি ঘটাতে পারে, অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমকে স্বচ্ছ রাখতে পারে এবং প্রতিষ্ঠানে জবাবদিহিমূলক সংস্কৃতি গড়ে তুলতে সক্ষম। এই কারণেই প্রশিক্ষিত, সৎ ও যোগ্য মানুষকে যথোপযুক্ত স্থানে নিয়োগ দেওয়াই দীর্ঘমেয়াদে আস্থা, স্থিতিশীলতা ও নৈতিক ব্যাংক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করে। এর সঙ্গে আরও একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ-সঠিক নেতৃত্ব শুধু সিদ্ধান্ত নেয় না, বরং প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি স্তরে নৈতিক আচরণের মানদণ্ড স্থাপন করে, যা সময়ের সঙ্গে ব্যাংকের সামগ্রিক সংস্কৃতি ও কার্যকারিতা উন্নত করে।

একটি টেকসই ও শক্তিশালী বাণিজ্যিক ব্যাংক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হলে নিয়ন্ত্রক সংস্থায় নীতিনিষ্ঠ, দক্ষ এবং দূরদর্শী নেতৃত্ব থাকতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার ওপরই নির্ভর করে ব্যাংক খাতে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কতটা কার্যকর হবে, মূলধন কতটা সুরক্ষিত থাকবে, বাজারে বিশ্বাসযোগ্যতা কতটা বজায় থাকবে এবং সুশাসন কতটা প্রতিষ্ঠিত হবে। এজন্য প্রয়োজন এমন নীতিনির্ধারকদের, যারা আর্থিক স্থিতিশীলতা রক্ষা করতে সক্ষম, ঝুঁকিপূর্ণ কার্যক্রম সীমিত করতে পারে এবং অনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রতিহত করতে পারে। এই দায়িত্ব পালনে তাদের গভীর বিশ্লেষণী দক্ষতা, স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এবং জনস্বার্থে অবিচল প্রতিশ্রুতি থাকা জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষেত্রে যারা বিশ্লেষণী সক্ষমতা, স্থির সিদ্ধান্ত নেওয়ার যোগ্যতা ও নৈতিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করেন, তাদেরই নেতৃত্বের স্থানে আনা উচিত। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানে কার্যকর শেখা-উন্নয়ন, উপযুক্ত প্রণোদনা এবং শক্তিশালী জবাবদিহি ব্যবস্থা থাকা দরকার, যেন পরিবর্তনশীল অর্থনৈতিক পরিবেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা আরও দক্ষতার সঙ্গে করা যায় এবং বিশেষ স্বার্থের বাইরে গিয়ে নীতি প্রণয়ন সম্ভব হয়।

বাংলাদেশের ব্যাংক খাত বহু বছর ধরে অদক্ষতা, অনিয়ম ও অনৈতিক আচরণের জটিলতায় ভুগছে। অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়তে থাকা খেলাপি ঋণ, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি, রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ অনুমোদন, পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই ছাড়া বিপুল ঋণ বিতরণ-এসবই দেখিয়েছে যে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং সুশাসনের অভাব দীর্ঘকাল স্থায়ী ছিল। অনেক ক্ষেত্রে যথাযথ মূল্যায়ন ছাড়া ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, ফলে ব্যাংকগুলো পরবর্তীতে বড় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয়েছে। বিশেষ করে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির প্রবণতা প্রমাণ করে দুর্বল শাস্তিমূলক ব্যবস্থা এবং রাজনৈতিক বা প্রাতিষ্ঠানিক প্রভাব কত দ্রুত আর্থিক শৃঙ্খলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। এসব অনিয়ম শুধু ব্যালেন্স শিট দুর্বল করে না, বরং স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতার ধারণা ক্ষতিগ্রস্ত করে পুরো আর্থিক ব্যবস্থার ওপর জনগণের আস্থা আরও কমিয়ে দেয়।

এদিকে, নিয়ম-কানুন থাকা সত্ত্বেও কার্যকর প্রয়োগে দুর্বলতা ব্যাংক খাতের সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করেছে। কখনও তদারকি ছিল অসম্পূর্ণ, কখনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বাধীনতার ঘাটতি ছিল, আবার অনেক সময় নীতি পর্যায়ে প্রয়োজনীয় কঠোরতা প্রয়োগ করা হয়নি। এর ফলে একই ধরনের ভুল বারবার ঘটেছে, এবং অপারেশনাল দুর্বলতার সঙ্গে নীতিগত ব্যর্থতা যোগ হয়ে ঝুঁকির মাত্রা আরও বেড়েছে। দুর্বল তদারকি ব্যবস্থার কারণে অনিয়মের সুযোগ বৃদ্ধি পায়, জালিয়াতি ও অযোগ্য পরিচালনার সম্ভাবনা বাড়ে এবং ব্যাংকের আর্থিক কাঠামো ধীরে ধীরে ভেঙে পড়তে থাকে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসব দুর্বলতা ব্যাংকের মূলধন ক্ষয় করেছে, বিনিয়োগকারীর আস্থা নষ্ট করেছে এবং দেশের অর্থনীতিকে বহুমাত্রিক ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে ভুল ব্যক্তিকে বসানোর প্রবণতা ভয়ংকর সমস্যা তৈরি করেছে। কখনও এমন ব্যক্তিরা নেতৃত্বের জায়গায় এসেছেন, যাদের পেশাগত দক্ষতা বা নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে; আবার কখনও বিশেষ স্বার্থ রক্ষার জন্য অযোগ্য ব্যক্তিদের শীর্ষপদে বসানো হয়েছে। নেতৃত্বের স্থান যখন ভুল মানুষের দখলে চলে যায়, তখন প্রতিষ্ঠানজুড়ে অনৈতিক সিদ্ধান্ত, অদক্ষ ব্যবস্থাপনা, ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা এবং শাসনব্যবস্থার ভাঙন দেখা দেয়। ভুল নেতৃত্ব অল্পকালের জন্য কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিলেও দীর্ঘমেয়াদে পুরো আর্থিক ব্যবস্থা এবং জনগণের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে শুধু ব্যাংক খাত নয়, দেশের অর্থনীতি ও বিনিয়োগ পরিবেশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা কার্যকর রাখতে নীতিগত স্বাধীনতা প্রয়োজনীয়। তবে সেই স্বাধীনতার সঙ্গে স্পষ্ট জবাবদিহি থাকতে হবে, যাতে কোনোভাবেই ক্ষমতার অপব্যবহার না ঘটে। স্বাধীনতা এমনভাবে প্রয়োগ করতে হবে, যা পেশাগত সিদ্ধান্তকে শক্তিশালী করবে কিন্তু ভুল সিদ্ধান্তকে রক্ষা করার ঢাল হয়ে দাঁড়াবে না। একই সঙ্গে সরকার এবং মুদ্রানীতি কর্তৃপক্ষের অযথা হস্তক্ষেপ বা রাজনৈতিক চাপ কমাতে পারলে পেশাজীবীরা স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালন করতে পারেন। সঠিক মানুষকে কাজ করার সুযোগ দিলে প্রতিষ্ঠানিক দক্ষতা, নৈতিকতা, স্বচ্ছতা ও সুশাসন দ্রুত উন্নত হয় এবং সামগ্রিক ব্যাংকিং খাত উপকৃত হয়। আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে স্বাধীনতা ও জবাবদিহির ভারসাম্যই এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

আজকের যুগে দক্ষ ও সৎ মানুষের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন প্রচারণা বা কিছু সংবাদমাধ্যম ব্যবহার করে অপপ্রচার চালানো অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। যোগ্য ব্যক্তিকে নেতৃত্বের জায়গা থেকে সরাতে বা তাদের কাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে ইচ্ছাকৃত নেতিবাচক প্রচারণা প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। এ ধরনের অপপ্রচার সৎ পেশাজীবীদের নিরুৎসাহিত করে, দায়িত্ব নিতে অনীহা তৈরি করে এবং ব্যাংক খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কারকে বিলম্বিত করে। মিথ্যা অভিযোগ, অসম্পূর্ণ তথ্য, গুজব এবং অনাকাঙ্ক্ষিত হস্তক্ষেপ শুধু ব্যক্তির ক্ষতি করছে না, বরং দীর্ঘমেয়াদে দেশের আর্থিক খাতকে দুর্বল করে এবং উন্নয়নগত গতি কমিয়ে দিচ্ছে।

ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য নিয়োগ, পদায়ন ও পদোন্নতিতে যোগ্যতা, সততা ও পেশাদারিত্বকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। যারা সৎ, দক্ষ, ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন, সময়োপযোগী নেতৃত্ব দিতে সক্ষম এবং প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে কাজ করতে প্রস্তুত—তাদেরই নেতৃত্বের দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন। ব্যক্তিগত সম্পর্ক, রাজনৈতিক প্রভাব বা বিশেষ স্বার্থে নেওয়া সিদ্ধান্ত ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণব্যবস্থাকে দুর্বল করে এবং কর্মক্ষমতা হ্রাস করে। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ ও ন্যায্য মানদণ্ড অনুসরণ করলে ব্যাংকের ভেতরে আত্মবিশ্বাস, শৃঙ্খলা, জবাবদিহি ও কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি পায়, যার প্রভাব গোটা আর্থিক ব্যবস্থায় ইতিবাচকভাবে প্রতিফলিত হয়।

বাংলাদেশের ব্যাংকখাতে  মেধাবী, যোগ্য, সৎ এবং দেশপ্রেমী মানুষের অভাব নেই; অভাব রয়েছে তাদের চিহ্নিত করা, উন্নয়ন করা এবং নেতৃত্বের জায়গায় আনার কার্যকর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার। টেকসই ব্যাংক খাতের জন্য প্রয়োজন আধুনিক প্রশিক্ষণ, পেশাগত উন্নয়ন, গবেষণাভিত্তিক নীতি প্রণয়ন এবং অভ্যন্তরীণ সক্ষমতা বৃদ্ধির কাঠামো। পাশাপাশি জাতীয় নীতি ও নিয়ন্ত্রক পর্যায়ে যোগ্যতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। নৈতিকতা, যোগ্যতা ও জবাবদিহিকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ভিত্তি করতে পারলেই ব্যাংক খাত দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারবে।

অদক্ষ কর্মশক্তি সৎ হলেও প্রাতিষ্ঠানিক উপকার নেই, আবার অসৎ এবং দক্ষ কর্মশক্তি প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর। বাংলাদেশে যথেষ্ট সক্ষম মানুষ রয়েছে, যারা নিষ্ঠা, সততা ও দক্ষতার সঙ্গে ব্যাংক খাতকে সঠিক ও নৈতিক পথে এগিয়ে নিতে পারে। প্রয়োজন শুধু তাদের খুঁজে বের করা, যথাযথ মূল্যায়ন করা এবং সঠিক জায়গায় দায়িত্ব দেওয়া। দেশের স্বার্থে, আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার স্বার্থে এবং ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক নিরাপত্তার স্বার্থে-যোগ্য মানুষকে সামনে আনা আজ সময়ের অপরিহার্য দাবি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *