আঞ্চলিক পর্যায়ে তথ্য বিনিময় ব্যাংকিং শিল্পের জন্য দিক নির্দেশক হতে পারে
(বণিক বার্তায় ২০১৮ সালে প্রকাশিত)
-ড. শাহ্ মোঃ আহসান হাবীব
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত গত চার দশকে অনেক পথ পাড়ি দিয়েছে। স্বাধীনতার পর যার সূচনা হয়েছিল অল্প কিছু এবং স্বল্প পরিসরে আর্থিক সেবা প্রদানের মাধ্যমে। প্রারম্ভিক পর্যায়ে ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা ছিল না এবং দক্ষতার ঘাটতি ছিল প্রকট। সময়ের সাথে সাথে এ খাতে আমূল পরিবর্তন এসেছে। সরকারী, বেসরকারী এবং বিদেশী ব্যাংকের সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের বর্তমান অবস্থা অনেকগুলো সংস্কারের মধ্য দিয়ে এসেছে। প্রতিযোগিতামূলক আর্থিক বাজার সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৮০ সালে প্রথম বেশ কয়েকটি ব্যাংকে কার্যক্রম শুরু করার অনুমতি প্রদান করা হয়। এরপর ব্যাংকিং খাতে প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যাংকিং খাত নিয়ন্ত্রণ সংক্রান্ত আইনগত পরিবর্তন শুরু হয় মূলতঃ নব্বই এর দশকে, যখন বাংলাদেশ সরকার বিশ্ব ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মূদ্রা তহবিলের সহায়তায় আর্থিক খাত সংস্কার কর্মসূচী শুরু করে। এই কর্মসূচীর ফলাফলের ভিত্তিতে পরবর্তীতে সরকার নিজেই পুনরায় ব্যাংকিং খাত সংস্কার প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। এছাড়া আরো তিন দফায় বেশ কিছু বেসরকারী ব্যাংকে আর্থিক খাতে কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয়। সার্বিক ভাবে এ সমস্ত পদক্ষেপ ব্যাংকিং খাতে প্রতিযোগিতা সঞ্চার করেছে। প্রাতিষ্ঠানিক পরিচালন ও অনুশাসনে পরিবর্তন এনেছে। তবে একথা অস্ব^ীকার করার উপায় নেই যে, কিছু কিছু সমস্যা এখনো বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের দক্ষতা অর্জনের পথে মূল অন্তরায় হয়ে আছে। এছাড়া সারাবিশ্বের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আর্থিক খাত সংক্রান্ত অপরাধ বৃদ্ধির সাথে সাথে ব্যাংকিং শিল্পকে নতুন অনেক ঝুঁকির মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
সার্বিক কার্যপরিধি, কাঠামো এবং আর্থিক মূল্যায়ন বিবেচনায় বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের পরিবর্তন লক্ষণীয়। সেবার ব্যাপ্তি বেড়েছে অনেক দিকে, নতুন নতুন অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাংক ঋণের আওতায় এসেছে। বেশীর ভাগ মানুষ আর্থিক সেবায় অন্তর্ভূক্ত হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আর্থিক খাতের সেবার গুণগতমানের উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে এবং ব্যাংকিং খাত সংক্রান্ত আইন ও নিয়ন্ত্রণমূলক নিয়মকানুনের আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে বেসরকারী ব্যাংকের প্রভাব লক্ষ্যণীয় হারে বাড়লেও অল্প কয়েকটি সরকারী ব্যাংক এখনো আর্থিক খাতের উল্লেখযোগ্য অংশীদার। তদারকী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক অনেক ক্ষেত্রেই আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেও সব ক্ষেত্রে কাঙ্খিত ফলাফল থেকে দূরে রয়েছে। বিশেষ করে সরকারী ব্যাংকগুলোকে সম্পূর্ণরূপে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ ও তদারকী ব্যবস্থার আওতায় আনা সম্ভব হয়নি। এছাড়া কয়েকটি সরকারী এবং বেসরকারী ব্যাংকের পারফরমেন্স ব্যাংকিং খাতের সার্বিক পারফরমেন্স সূচকগুলোকে প্রভাবিত করছে। বিশেষ করে কিছু বেসরকারী ও সরকারী ব্যাংকের ঋণমান বর্তমান সময়ের আলোচনার বিষয়। গত এক দশকে শ্রেণীকৃত ঋণের আনুপাতিক হারে ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে এবং কিছু কিছু বেসরকারী ব্যাংক এক্ষেত্রে দক্ষতা দেখিয়েছে। তথাপি সার্বিকভাবে ব্যাংকিং খাতের ঋণ ব্যবস্থাপনায় আরো উল্লেখযোগ্য এবং দৃশ্যমান পরিবর্তন দরকার। বিশেষতঃ সরকারী ব্যাংকগুলো এ সমস্যার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে না। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, শ্রেণীকৃত ঋণের একটি অংশ ইচ্ছাকৃতভাবে ফেরত দেয়া হচ্ছে না। আর আমাদের প্রচলিত জবাবদিহি ব্যবস্থায় এগুলোকে আলাদা করে উপস্থাপনের উপায় নেই। সাধারণ জনগণের সঞ্চিত অর্থের এমন অপব্যবহার অবশ্যই গর্হিত অপরাধ হিসেবে পরিগণিত হওয়া উচিত। প্রকৃত পক্ষে ঋণ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে রাখা বর্তমানে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ। বিশেষতঃ ইচ্ছাকৃতভাবে সৃষ্ট শ্রেণীকৃত ঋণের পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে আনা না গেলে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা কঠিন হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে এমন জোরেসোরে আলোচনা ও পর্যালোচনা বোধকরি আমাদের একটি কাঙ্খিত সমাধানের দিকে নিয়ে যাবে। প্রকৃতপক্ষে ব্যাংকিং খাতের সমস্যা সমাধানে সকল অংশীদারী পক্ষের মাঝে আলোচনা-পর্যালোচনা চালিয়ে যাবার বিকল্প নাই, আর এর মাধ্যমে হয়তো সঠিক পথনির্দেশনা পাওয়া সম্ভব।
বিশ্ব ব্যাংকিং খাতে সময় বয়ে এনেছে অসংখ্য সম্ভাবনা আর ঝুঁকি। সময়ের বিবর্তনে বাংলাদেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে। বেড়েছে প্রতিযোগিতা, নতুন নতুন ব্যাংকিং পণ্য বাজারে এসেছে। তবে ক্ষেত্র ও ব্যাপ্তি বৃদ্ধির সাথে সাথে যেমন নতুন নতুন সম্ভাবনার দ্বার উম্মোচিত হয়েছে, তেমনি এদেশেও তৈরী হয়েছে অসংখ্য নতুন ধরণের ঝুঁকি। বিশেষতঃ আর্থিক খাত সংক্রান্ত অপরাধগুলো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অনেকটা একই রকম। প্রতিবেশী দেশগুলোতে এ বিষয়ে আরও বেশি সাদৃশ্য খুজে পাওয়া যায়। এ সময়ে কার্যকর ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ব্যাংকিং খাতের স্থিতিশীলতা বজায় এবং দক্ষতা বৃদ্ধি সকল অংশীদারী পক্ষের সার্বজনীন লক্ষ্য। ব্যাংকিং স্থিতিশীলতা ও দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক, সরকার, ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ এবং ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ নানাবিধ আইন ও নীতি প্রণয়ন, কৌশল নির্ধারণ ও তার বাস্তবায়ন এবং ব্যাংকিং সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে এক্ষেত্রে সময়ের প্রয়োজনে সকল অংশীদারী পক্ষকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। এছাড়া, আর্থিক দূর্নীতির সম্প্রসারণ, মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত উদ্বেগ এবং ডিজিটাল নিরাপত্তা ঝুঁকি ব্যাংকিং খাতের নীতিনির্ধারক এবং ব্যবস্থাপনা-কে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করছে।
বিআইবিএম-এর বার্ষিক ব্যাংকিং সম্মেলন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে জ্ঞান ব্যবস্থাপনার একটি অন্যতম ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। এ আয়োজনের উদ্দেশ্য ব্যাংকার, গবেষক, শিক্ষাবিদ ও এ খাতের নীতিনির্ধারকবৃন্দের মাঝে আলোচনা ও সমালোচনার সুযোগ করে দেয়া। এবছর প্রথমবারের মত বিআইবিএম আরো বৃহৎ পরিসরে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পর্যায়ে এই জ্ঞান ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রটিকে বিস্তৃত করার প্রয়াস নিয়েছে। আঞ্চলিক ব্যাংকিং সম্মেলন ২০১৮ আয়োজন করা হচ্ছে আজ থেকে অর্থাৎ ৪ মার্চ থেকে। দু’দিনের এই আয়োজনের উদ্বোধন করছেন বিআইবিএম-এর গভর্নিং বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির। বিআইবিএম এর সাথে এ আয়োজনে সহযোগী হয়েছে ভারত এর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব্ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (এনআ্ইবিএম); নেপাল এর ন্যাশনাল ব্যাংকিং ইনস্টিটিউট (এনবিআই) এবং ভ‚টান এর ফাইন্যান্সিয়াল ইনস্টিটিউশন্স ট্রেনিং ইনস্টিটিউট (ফিটি)। তিনটি প্রতিষ্ঠানই স্ব স্ব দেশের ব্যাংকি খাতে প্রশিক্ষণ, শিক্ষা ও গবেষণা প্রদান সংক্রান্ত জাতীয় পর্যায়ের প্রতিষ্ঠান। সম্মেলনে চারটি দেশের বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের প্রশিক্ষক, গবেষক এবং শীর্ষ নির্বাহীবৃন্দ গবেষণাপত্র এবং অভিজ্ঞতা বিনিময় করবেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের পর বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও ভ‚টানের ব্যাংকিং খাতের উপর চারটি সমষ্ঠিক গবেষণা উপস্থাপন করা হবে, যা থেকে প্রতিবেশী দেশগুলোর ব্যাংকিং খাতের তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় দিন বিষয়ভিত্তিক প্রবন্ধ উপস্থাপিত হবে। প্রথম সেশনটির মূল বিষয় আর্থিক অন্তর্ভূক্তি ও ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা এবং দ্বিতীয় সেশনটির বিষয় ব্যাংকিং খাতের মানব সম্পদ উন্নয়ন। এছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিআইবিএম কর্তৃক পরিচালিত “আন্তর্জাতিক বাণিজ্য” ও “ঋণ ব্যবস্থাপনা” বিষয়ক দুটি সার্টিফিকেশন কোর্সের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে। এ আয়োজনে মিডিয়া পার্টনার হিসেবে বণিক বার্তা, চ্যানেল ২৪ এবং ঢাকা ট্রিবিউন এবং অনলাইন পার্টনার হিসেবে আমরা নেটওয়ার্ক সম্পৃক্ত রয়েছে।
এই ব্যাংকিং সম্মেলন অত্যন্ত জরুরী প্রায়োগিক গবেষণাকে উৎসাহিত করার চেষ্টা করছে এবং ব্যাংকিং খাতের সাথে সম্পৃক্ত নীতি নির্ধারক ও শীর্ষ পর্যায়ের নির্বাহীদের অংশগ্রহনের মাধ্যমে প্রয়োগযোগ্য সুপারিশমালা বের করে আনার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং ভ‚টানের অর্থনৈতিক ও আর্থিক কাঠামো এবং সার্বিক ব্যবস্থায় অনেক মিল রয়েছে। সামঞ্জস্য রয়েছে দেশগুলোর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড ও দৃষ্টিভঙ্গীর। আঞ্চলিক ব্যাংকিং সম্মেলনের মত এরকম আয়োজন আমাদের সমস্যাগুলোকে উপস্থাপনের, আলোচনার এবং তা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে সহায়তা করবে। আমার বিশ্বাস আজকের বিআইবিএম-এর আঞ্চলিক সম্মেলনের ব্যাংকিং খাত সংক্রান্ত সমষ্ঠিক চিত্রের উপস্থাপন বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতের ভবিষ্যত পথ চলায় ভূমিকা রাখবে।
লেখক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব্ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর অধ্যাপক ও পরিচালক প্রশিক্ষণ হিসেবে কর্মরত আছেন এবং আঞ্চলিক ব্যাংকিং সম্মেলন-২০১৮ এর কার্যকরী কমিটির সভাপতি।