অর্থনীতিতে ব্যাংক খাতের প্রয়োজনীয়তা এবং ব্যাংক খাতের উপর জনসাধারণের অবিচল আস্থার অনিবার্যতা

September 15, 2023
563
Views
[জানুয়ারী ২০২৩ সালে বনিক বার্তায় প্রকাশিত]

বলা হয় ‘আর্থিক খাত একটি দেশের পাকস্থলী, যেখান থেকে অর্থনীতির অন্যান্য অঙ্গ  শক্তি আহরণ করে’ এবং আর্থিক বা ব্যাংক খাতের সঙ্গে অর্থনীতির আন্তঃসম্পর্ক এবং  অর্থনৈতিক উন্নয়নে আর্থিক খাতের ভূমিকার ক্ষেত্রগুলোকে অর্থনীতিবিদরা বিভিন্নভাবে নিজস্ব দৃষ্টিকোণে চিত্রায়িত করেছেন। বিভিন্ন দেশে আর্থিক খাতের বিন্যাস আলাদা এবং এর বিভিন্ন অঙ্গের অংশীদারত্ব দেশ  ভেদে ভিন্ন আকারের। উন্নয়ন পর্যায়ের বিবেচনায়ও বিশ্বের উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর আর্থিক খাতকে  আলাদা করা যায়। সাধারণত উন্নত দেশের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশে ব্যাংক খাতের আধিপত্য স্পষ্ট এবং  এতে অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যাংক খাতের সংশ্লিষ্টতা অপেক্ষাকৃত বেশি দৃশ্যমান। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য অনেক বেশি স্পষ্ট।

আমাদের অর্থনীতি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে প্রায় সব ধরনের আর্থিক সহায়তার জন্য অনেকটা এককভাবেই আমরা ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণেই কভিড-১৯ মহামারীর প্রথম ঢেউয়ের পর থেকে এবং তার পরবর্তী সময়ে বিশ্ব অর্থনৈতিক অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখার জন্য  যেসব এবং যে মাত্রায় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়ে আসছে, তাতে দেশের ব্যাংকগুলোকে বেশ দায়িত্বশীলতা ও ঝুঁকির মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। সব ধরনের লেনদেন, আমানত ও ঋণের সঙ্গে দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকের যে সংশ্লিষ্টতা তা ব্যাংক কার্যক্রমের তাত্ত্বিক পরিভাষা থেকে ভিন্ন।বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে সামগ্রিকভাবে অর্থায়ন পরিস্থিতি এবং এ খাত থেকে যে  পরিমাণ প্রত্যাশাএ দুইয়ের মধ্যকার ব্যবধান ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতিকে আরো জটিল  করে তুলেছে, যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সহায়তায় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সামলে নেয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে দেশের ব্যাংক খাত।

‘মালিকানা’, ‘নেতৃত্ব’, ‘পরিচালন পদ্ধতি’, ‘সিদ্ধান্ত গ্রহণব্যবস্থা’ ও ‘ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা’ ব্যাংক খাতের পরিচালনা ও সফলতার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। এ প্রক্রিয়ায় একটি দেশের আমানতকারীরা এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি  সাধারণ আমানতকারীদের অবিচল আস্থা সফলতার একটি অন্যতম প্রভাবক। পাঠ্যবইয়ের ভাষা অনুসারে শেয়ারহোল্ডাররাই একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রকৃত  মালিক। তত্ত্বটি বাণিজ্যিক ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সত্য বলে মনে হয় না। মালিকানার সঙ্গে মূলধনের সম্পৃক্ততা ও ঝুঁকি গ্রহণ একান্তভাবে সম্পর্কিত। বাণিজ্যিক ব্যাংক যখন প্রথম স্থাপন করা হয়, তখন স্বল্পসংখ্যক উদ্যোক্তা তাদের পুঁঁজি  বিনিয়োগের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ এবং এ-সংক্রান্ত ঝুঁকি গ্রহণ করে থাকেন। ব্যাংকের আত্মপ্রকাশ একটি অর্থনীতিতে শরীরের রক্তনালির সঙ্গে একটি নতুন অঙ্গ যুক্ত করার শামিল ।সংযুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতির এ অঙ্গে রক্তপ্রবাহ অথবা ব্যাংকে আমানতকারীর অর্থপ্রবাহ শুরু হয়। অর্থাৎ নতুন বিনিয়োগকারী ও ঝুঁকিগ্রহণকারীর সম্পৃক্ততা ঘটে ব্যাংকের সঙ্গে। সঙ্গে সঙ্গে সমীকরণ পাল্টে যায় এবং আমানতকারীরা মালিকানা সত্ত্বার বিচারে সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকে পরিণত হন। আর উদ্যোক্তারা বা পর্ষদ সদস্যরা হয়ে যান সংখ্যালঘিষ্ট মালিকচক্র। সুতরাং ব্যাংকের প্রকৃত মালিক বা সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকরা আর কেউ নন, সামগ্রিকভাবে আমানতকারীরা। ব্যাংকের সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিক যদি সাধারণ আমানতকারীরা হন, তাহলে যেকোনো ব্যাংকের প্রকৃত মালিক রাষ্ট্র। আমানতকারীরা মূলত সরকারি বা বেসরকারি নন বরং দেশের সাধারণ নাগরিক। সেক্ষেত্রে ব্যাংকের ক্ষেত্রে ‘সরকারি’ বা ‘ব্যক্তিমালিকানাধীন’ শব্দগুলোর থেকে ‘সরকারি খাতে পরিচালিত ব্যাংক’ এবং ‘ব্যক্তি খাতে পরিচালিত ব্যাংক’ নামগুলো অধিকতর গ্রহণযোগ্য মনে হয়।

মালিকানার সঙ্গে সিদ্ধান্ত গ্রহণের বিষয়টি সরাসরি সম্পৃক্ত। যেহেতু আমানতকারীদের অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকদের স্বার্থ তারা নিজেরা সরাসরি সংরক্ষণ করতে পারে না, তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মূল দায়িত্ব থাকে আমানতকারীর অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিকদের স্বার্থ সংরক্ষণ। সংখ্যালঘু মালিকপক্ষ অর্থাৎ শেয়ারহোল্ডাররা পরিচালনা পর্ষদের অংশ হিসেবে তাদের স্বার্থ সংরক্ষণের সুযোগ পান, যেহেতু তারাই সাধারণত সূচনাকারী উদ্যোক্তা এবং সর্বোচ্চ ঝুঁকি গ্রহণকারী। এক্ষেত্রে পরিচালনা পর্ষদ সংখ্যাগরিষ্ঠ মালিক পক্ষের অর্থাৎ আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দেবেন এমনটাই আশা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে একটি ব্যাংকের দীর্ঘকালীন স্বার্থ সংরক্ষণমূলক উদ্যোগ, নিয়ন্ত্রিত ঝুঁকিগ্রহণ এবং দক্ষ পরিচালনা স্বাভাবিকভাবে প্রতিষ্ঠানের শেয়ারহোল্ডার ও আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণে কাজ করে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে ও তত্ত্বাবধানে পরিচালনা পর্ষদের দায়িত্বশীল আচরণ একটি ব্যাংকের টেকসই বিকাশে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ।

সরকারি বা বেসরকারি যে খাতেই একটি বাণিজ্যিক ব্যাংক পরিচালিত হোক না কেন,  আমানতকারীর স্বার্থ সংরক্ষণের বিষয়টিই সবসময় মূল লক্ষ্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেক্ষেত্রে আমানতকারীর স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব সামগ্রিকভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও  পরিচালনা পর্ষদের। এ দুই পক্ষের ব্যর্থতা বা দায়িত্বশীল আচরণের ব্যত্যয় হলে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার মাঝে  অধিক ঝুঁকি নেয়ার প্রবৃত্তি জন্ম নিতে পারে এবং ব্যাংকের আর্থিক স্থিতি সার্বিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, ব্যাংক খাতের আর্থিক দুর্দশা ও আস্থা সংকট শুধু আমানতকারী বা শেয়ারহোল্ডারদের জন্য ক্ষতিকর নয় বরং ব্যাংক খাতের অচলাবস্থা অর্থনৈতিক মন্দার  জন্ম দিয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করতে পারে। যুগে যুগে এমনটি প্রমাণিত হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি স্বল্প, মাঝারি ও দীর্ঘমেয়াদি সব ধরনের আর্থিক সেবার জন্য ব্যাংক খাতের ওপর নির্ভরশীল এবং টেকসই উন্নয়নের বিষয়গুলোকে ধারণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও দেশের ব্যাংক খাত টেকসই এবং প্রযুক্তিভিত্তিক আর্থিক সেবার ক্ষেত্রেও বহুমুখী পদক্ষপে নেয়ার চেষ্টা করছে। দেশের অর্থনীতিতে ব্যাংক খাতের সম্পৃক্ততা ও কার্যপরিধি স্পষ্টভাবে তাদের ভূমিকার  বিষয়টি নির্দেশ করে এবং এ কথা বলা অযৌক্তিক নয় যে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা  অব্যাহত রাখতে হলে ব্যাংক খাতের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করা অপরিহার্য এবং ব্যাংক খাতের আস্থা রক্ষার প্রচেষ্টা সমুন্নত রাখার বিকল্প নেই।

কভিড জটিলতা কাটিয়ে ওঠার প্রচেষ্টার পর্যায়ে দেশের অর্থনীতি, বৈদেশিক বিনিময় বাজার ও আর্থিক খাত বিশ্ব অর্থনীতির অনিশ্চয়তার প্রভাবে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তা মোকাবেলার। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতের কিছু ঘটনাবলি নীতিনির্ধারক ও সাধারণ আমানতকারীদের  উদ্বেগের কারণ হয়েছে স্বল্পসময়ের জন্য হলেও। এ বিষয়গুলো ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদ ও শীর্ষ ব্যবস্থাপনার প্রতি আরো অধিক দায়িত্বশীল আচরণের প্রয়োজনীয়তার ইঙ্গিত দেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের দ্রুত প্রতিক্রিয়া ও কার্যকরী পদক্ষেপ ব্যাংক খাতের প্রতি সাধারণ  আমানতকারী তথা সাধারণ মানুষের সবচেয়ে বড় আস্থার জায়গা। মনে রাখা প্রয়োজন, একটি ছোট্ট খবর ব্যাংক খাতের প্রতি সাধারণের আস্থায় চিড় ধরাতে পারে। সেক্ষেত্রে গণমাধ্যমও আরো অধিক দায়িত্বশীলতা দেখাবেন বলে এমনটা আশা করা যুক্তিপূর্ণ মনে করি।

সামনের দিনগুলোয় ব্যাংক খাতের অগ্রযাত্রা নিশ্চিতে মন্দ ঋণ কমিয়ে আনা এবং ঝুঁকি বিবেচনায় ব্যাংকগুলোকে আরো দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। এক্ষত্রে ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদ এবং শীর্ষ ব্যবস্থাপনার অধিকতর দায়িত্বশীল  আচরণ অত্যন্ত জরুরি। ব্যাংক খাতে ঝুঁকিগুলো চিহ্নিতকরণ ও প্রকৃত ক্যাপিটাল বা মূলধনের পরিমাণ নিরূপণ  এবং যথেষ্ট পরিমাণ সংরক্ষণ করে আগামী দিনের সম্ভাব্য বিপদগুলো মোকাবেলা করার জন্য ব্যাংক খাতকে তৈরি রাখতে হবে। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের যেমন আইনের আওতায় আনার বিকল্প নেই, তেমনি অনিচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের সহযোগিতা করা একান্ত প্রয়োজন। ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি সমস্যা সমাধানে ‘ব্যাংক কোম্পানি (সংশোধন) আইন ২০২১’  সরকারের আর্থিক খাতের উন্নয়নে একটি অত্যন্ত প্রশংসনীয় উদ্যোগ, যার সফল  বাস্তবায়ন দেশের ব্যাংক খাতের কিছু মৌলিক সমস্যা সমাধানে অবদান রাখতে পারে।

ড. শাহ্ মো. আহসান হাবীব : অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *