ছায়া ব্যাংকিং ও আর্থিক অন্তর্ভূক্তি
অধ্যাপক শাহ্ মোঃ আহসান হাবীব
ছায়া ব্যাংকিং অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারণা নিয়ে পরিচিতি লাভ করলেও প্রকৃতপক্ষে ছায়া ব্যাংকিং এর গুণাগুণ এবং প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করার উপায় নেই বরং অনেক ক্ষেত্রে ছায়া ব্যাংকিং এর প্রভাব অর্থনীতি ও আর্থিক খাতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করা হয়। বিশেষত আর্থিক অন্তর্ভূক্তির লক্ষ্য অর্জনে এবং স্বল্প আয়ের সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অবহেলিত জনগনকে আর্থিক ও অর্থনৈতিক খাতের আওতায় আনার কৌশল হিসেবে ছায়া ব্যাংকিং বিশেষভাবে কার্যকরী হতে পারে।
বিশ্বের বেশ কিছু দেশে ক্ষুদ্রঋণ সেবা এবং আর্থিক অন্তর্ভূক্তির আওতায় বিশেষভাবে পরিচালিত আর্থিক কার্যক্রম নিয়ন্ত্রক সংস্থার কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও নজরদারীর বাহিরে রাখা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা, সমবায় সংস্থা, ঋণ সমিতি বা ক্রেডিট ইউনিয়ন, আমানত সংস্থা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নিয়ন্ত্রণ এর বিবেচনায় এগুলোকে অনেকটাই স্বল্প-নিয়ন্ত্রিত (ংবসর-ভড়ৎসধষ) বা অনিয়ন্ত্রিত (রহভড়ৎসধষ) প্রতিষ্ঠান বা আর্থিক সেবা কার্যক্রম বলা যায় । অবশ্যই এ সমস্ত কার্যক্রম বেআইনি নয়, শুধুমাত্র স্বল্প নিয়ন্ত্রিত এবং ব্যাংকের তুলনায় কম নজরদারির মধ্যে পরিচালিত।
একথা অজানা নয় যে, ক্ষদ্রঋণ কার্যক্রম সারা পৃথিবীতে বিস্তার লাভ করেছে মূলতঃ স্বল্প আয়ের দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে আর্থিক সেবার আওতায় আনার জন্য। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের মডেলগুলো বিশ্বব্যাপী বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে এবং বাংলাদেশে পরিচালিত প্রক্রিয়াগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বিশ্বমন্দার পরিপ্রেক্ষিতে ছায়া ব্যাংকিং এর সুযোগে যে সমস্ত ঋণ রূপান্তর এবং দায় ও তারল্য সংক্রান্ত ঝুঁকি তৈরি হয়েছিল তা এধরনের ক্ষুদ্র ঋণ ও আমানত সেবার জন্য প্রযোজ্য হতে পারে বলে মনে হয় না। বরং এধরনের ছায়া ব্যাংকিং কার্যক্রম স্বল্প নিয়ন্ত্রণ ও সীমিত নজরদারীর কারণে সহজে সরবরাহযোগ্য ও এর আওতায় সেবা প্রদানের খরচ বেশ কম। স্বল্প আয়ের দরিদ্র মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী এ সমস্ত আর্থিক সেবা ক্ষেত্র অনুসারে পরিবর্তনযোগ্য। এ সকল বৈশিষ্টের কারণেই ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলো আর্থিক অন্তর্ভূক্তির ক্ষেত্রে বেশ সফলতার সাথে স্বল্প ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে অনেক ক্ষেত্রেই পৌছাতে সক্ষম হয়েছে। ব্যাংক এর মত কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারী এধরনের বিশেষ আর্থিক সেবা পণ্য কার্যক্রমের ক্ষেত্রে লক্ষ্য অর্জনে ফলদায়ক হয় না বরং অনেকক্ষেত্রেই বাঁধার কারণ হয়ে উঠতে পারে।
তবে একেবারে অনিয়ন্ত্রিত ক্ষুদ্রঋণ ও আর্থিক সেবা কার্যক্রমের পরিচালনা পর্যায়ে স্বেচ্ছাচারীতা, শোষণ এবং অপরাধের প্রবণতা তৈরী হতে পারে। সেবা প্রদানকারী ও গ্রহণকারী দু-পক্ষের জন্যই নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনীয়তা আছে। তবে কতটুকু নিয়ন্ত্রণ ক্ষুদ্রঋণ ও ক্ষুদ্র আমানত সেবা কার্যক্রমের লক্ষ্যকে ব্যাহত করবে না তা বিতর্কের উর্ধ্বে নয়। তবে, সাধারণভাবে এ সকল কার্যক্রম ব্যাংক এর মত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হবার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশে স্বল্প আয়ের গ্রামীণ জনপদ বিশেষত নারী সমাজকে আর্থিক খাতে সম্পৃক্ত করার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলোর প্রচেষ্টা ও সফলতা আর্থিক অন্তর্ভূক্তি অর্জনে একটি বড় উদাহরণ। বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোকে যৌক্তিক নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারীর আওতায় আনার জন্য ২০০৬ সালে ’মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরী অথরিটি’ বা এমআরএ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এধরনের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রমকে সুসংগঠিত করছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের ন্যুনতম নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারী অপরিহার্য যখন ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলো বাংলাদেশ সহ বেশ কিছু উন্নয়নশীল দেশে ব্যাংক এর সাথে যৌথভাবে গ্রামীন ও স্বল্প আয়ের মানুষদের জন্য আর্থিক পণ্য সরবরাহে কাজ করছে। এ ধরনের সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে, ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থায় যে কোন ধরনের সমস্যা ও অপরাধ সংগঠিত হলে তা ব্যাংকিং খাতে সমস্যা তৈরি করতে পারে। এজন্যই নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারীর প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। অবশ্যই এ নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারী ব্যাংক এর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারীর সাথে তুলনীয় নয়। বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশে ক্ষুদ্রঋণ ও আমানত সেবা এহেন স্বল্প নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারীতে পরিচালিত হচ্ছে।
গ্রামীণ ছোট ও স্বল্প আয়ের কৃষকদের ঋণ সমস্যা মোকাবেলায় ছায়া ব্যাংকিং গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে এধরনের আর্থিক পণ্যের বিকাশ ও সফলতা বিশেষভাবে লক্ষণীয়। যেমন চীন এ জমির প্রকৃত মালিক রাষ্ট্র এবং সাধারনত কৃষকরা জমিকে ঋণের জামানত হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধা আছে। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো স্বল্প আয়ের কৃষকদের ঋণ প্রদানে উৎসাহী নয়। সে শুন্যস্থান গুলোই পুরণ করছে চীনের ছায়া ব্যাংকিং এর বেশ কিছু আর্থিক পণ্য। চীনের ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থা, ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি (ঢ়২ঢ়) সরাসরি ঋণ কার্যক্রম ও বেশ কিছু অ-ব্যাংক প্রতিষ্ঠান ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং কৃষকদের ঋণ ও আর্থিক সেবা প্রদানে কাজ করছে। বেশ কিছু নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক ও এধরনের স্বল্প নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করছে। ভারতের ছায়া ব্যাংকিং কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সমর্থনে বিকশিত হচ্ছে। বাংলাদেশে কৃষক ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উন্নয়নে ব্যাংক এবং অ-ব্যাংক প্রতিষ্ঠানগুলো (নিয়ন্ত্রিত) তাদের নিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমের মাঝেই বিশেষ আর্থিক পণ্যের প্রচলন ও সরবরাহ করছে। এছাড়া কৃষক ও দারিদ্র বিমোচনে স্বল্প নিয়ন্ত্রিত ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থার কার্যক্রম দেশে ও সারা বিশ্বে বিশেষভাবে সমাদৃত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বাংলাদেশের ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলো ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ সমস্যা মেটাতে বিশেষভাবে কাজ করছে। এ সমস্ত স্বল্প নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান অনেক ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান অর্থাৎ ব্যাংকের তুলনায় ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেশি জনপ্রিয়।
আর্থিক খাতের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ও কার্যকরী পণ্যের নাম হল বীমা। সাধারণভাবে বীমা প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারীর মধ্যে পরিচালিত হয়। তবে একেবারে ব্যাংক এর মত কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারীর মধ্যে নয়। ক্ষুদ্র কৃষকশ্রেনী এবং সার্বিকভাবে কৃষিক্ষেত্র আবহাওয়ার উপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে আবহাওয়াজনিত কারণে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে ঋণ প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে। কৃষক ও কৃষিখাতের জন্য বিশেষ বীমা পণ্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতে গুরুত্বর্পূণ ভূমিকা রাখছে। ব্যাংক ও ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলো অনেক ক্ষেত্রেই কৃষকদের ঋণের সাথে বীমা পণ্যকে সমন্বয় করে সরবরাহ করছে। বাংলাদেশে বীমা খাতকে যৌক্তিক কারণেই আর্থিক সেবার সাথে সংগতিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে আনা হয়েছে “বাংলাদেশ ইনস্যুরেন্স ডেভেলপমেন্ট রেগুলেটরী অথরিটি” এর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। তবে বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় দেশের বীমা খাত ব্যাংকের তুলনায় স্বল্প নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারিতে আছে। কৃষি এবং ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের আর্থিক সেবার বিকাশে বীমা সেবা একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় খাত।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মোবাইল প্রযুক্তি ছায়া ব্যাংকিং এর বিস্তার এবং আর্থিক অন্তর্ভূক্তির লক্ষ্য অর্জনে বিশেষ সহায়ক ভ‚মিকা পালন করছে। তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক ব্যাংকিং এ মোবাইল ব্যাংকিং এর সংযুক্তি অত্যাবশ্যকীয়ভাবে অ-ব্যাংক প্রতিষ্ঠানের বা স্বল্প নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান যেমন মোবাইল কোম্পানি, মোবাইল এজেন্ট ইত্যাদির সম্পৃক্ততা বাড়িয়েছে। বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশে মোবাইল ব্যাংকিং আর্থিক অন্তর্ভূক্তিতে বড় ধরনের পরিবর্তন এনেছে। অন্যান্য আর্থিক সেবা পণ্য যেমন ক্ষুদ্রঋণ, বীমা ও আমানত সংগ্রহের ক্ষেত্রেও মোবাইল প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করতে শুরু করেছে। এজেন্ট ব্যাংকিং এর বিকাশ বাংলাদেশের আর্থিক অন্তভর্‚ক্তির লক্ষ্য অর্জন ও গ্রামীণ এবং স্বল্প আয়ের মানুষের মাঝে ঋণ ও আমানত সেবার বিকাশে ইতিবাচক পরিবর্তনের বার্তা দিচ্ছে। বাংলাদেশ সহ অনেক উন্নয়নশীল দেশে মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিং সেবা সাধারণত নিয়ন্ত্রিত আর্থিক ব্যবসার সাথে সংযুক্ত হয়ে প্রদান করা হলেও, কোন কোন ক্ষেত্রে বিশেষত উন্নত দেশে, শুধুমাত্র মোবাইল এবং ওয়েব নেটওয়ার্ক ব্যবহার করেও সরাসরি আর্থিক সেবা প্রদান করার নিদর্শন আছে।
উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক অন্তর্ভূক্তির লক্ষ্য অর্জনে তথ্য প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যাংকিং এর বিকাশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে যা একই সাথে ছায়া ব্যাংকিং এর উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধির কারণও বটে। ব্যাংকিংখাত নিয়ন্ত্রণ এবং ছায়া ব্যাংকিং এর কোন কোন আর্থিক পণ্যের ক্ষেত্রে আর্থিক নজরদারী যেমন জরুরী, আর্থিক অন্তর্ভূক্তি সংক্রান্ত ছায়া ব্যাংকিং এর বিকাশের ক্ষেত্রে স্বল্প নিয়ন্ত্রণ এবং সীমিত নজরদারীই বেশী কার্যকর বলে মনে হয়।