কোভিড-১৯ এবং বিশ্ব বানিজ্যে ব্যাংকিং সেবা
(বর্ণিক বার্তায় ২০২০ সালে প্রকাশিত)
অধ্যাপক শাহ্ মোঃ আহসান হাবীব
সাম্প্রতিক সময়ের সমস্ত পূর্বাভাস অর্থনৈতিক ও বিশ্ব বানিজ্যের সমাগত মন্দার ইঙ্গিত করছে। চীন থেকে শুরু করে বিশ্ব বানিজ্যের সমস্ত মূল অংশীদার বর্তমানে করোনা যুদ্ধে অবতীর্ণ। বিশ্ব অর্থনীতির সমস্ত দেশ গুলোতে ব্যবসা বানিজ্য এবং উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে অথবা সংকোচিত হয়েছে সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার প্রভাবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ও জাহাজ চলাচলে বিঘœ ঘটেছে সারা বিশ্বজুড়ে। আমদানীকারকরা সময়মত বন্দর থেকে পণ্য খালাস করতে পারছে না আর রপ্তানীকারকরা যথাসময়ে জাহাজীকরণ এ ব্যর্থ হচ্ছে। সবমিলিয়ে বিশ্ব বানিজ্য মারাত্মক হুমকির মুখে এসে দাড়িঁয়েছে এবং বিশ্ব সরবরাহ চেইন ভীষনভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। আর এ সমস্ত অর্থনৈতিক ও আর্থিক ধ্বংসযজ্ঞের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্ব বানিজ্যে ব্যাংকিং সেবার উপরে। অর্থনৈতিক ও বিশ্ব বানিজ্য সংকোচনের সরাসরি প্রভাব পড়তে শুরু করেছে এ সংক্রান্ত সবধরনের ব্যাংকিং সেবা কার্যক্রমে। বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর একটি বড় আয়ের উৎস হলো বিশ্ব বানিজ্য সংক্রান্ত আর্থিক সেবা। বর্তমানে উদ্বুত পরিস্থিতিতে ব্যাংকের এ ধরনের আর্থিক সেবা দ্রæত হারে সংকোচিত হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ের পূর্ভাবাস বলছে, বিশ্ব বানিজ্য সংক্রান্ত আর্থিক সেবা থেকে আয় বহুলাংশে কমে যাবে সামনের মাসগুলোতে। বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে বৈদেশিক বানিজ্য সংকোচনের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। ঐতিহ্যগতভাবে বৈদেশিক বানিজ্য সংক্রান্ত ব্যাংক ঋণ এ মন্দ ঋণের পরিমাণ অনেক কম। কোভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দা এ ঐতিহ্যের অবসান ঘটাবে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষতঃ ছোট আকারের ব্যাংকগুলোর জন্য মন্দ ঋণের বোঝা বহন অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
তৈরি পোশাকখাত বাংলাদেশে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর বৈদেশিক বানিজ্য সংক্রান্ত আর্থিক সেবা সংক্রান্ত আয়ের মূল উৎস। বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের মূল ভোক্তা হলো ইউরোপিয়ান রাষ্ট্রগুলো এবং যুক্তরাষ্ট্র। বড় অংশের কাচাঁমাল আমদানী করা হয় চীন থেকে। প্রকৃতপক্ষে চীন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বানিজ্য অংশীদার রাষ্ট্র। সুতরাং সবগুলো বড় অংশীদার রাষ্ট্র ইতিমধ্যে করোনা আক্রমনে ভীষনভাবে পর্যুদস্ত। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক মন্দা সরাসরি বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতকে আঘাত করতে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে।
সর্বশেষ বিশ্ব আর্থিক মন্দার অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে যুক্তরাষ্ট্রের একজন বিশেষজ্ঞ এক সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সংকোচিত দেশীয় আয় চীন ও বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের জন্য বেশ ক্ষতিকর হতে পারে। গবেষণার প্রাক্কলণে বলা হয়েছে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ৫ থেকে ১০ ভাগ দেশীয় উৎপাদন কমলে বাংলাদেশ থেকে তৈরী পোশাক রপ্তানী ৭ থেকে ১৭ ভাগ কমবে এবং বাংলাদেশের তৈরী পোশাক খাতের ৪ থেকে ৯ ভাগ শ্রমিক চাকুরি হারাবে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৩ বিলিয়নের অধিক মূল্যের তৈরী পোশাক রপ্তানীর চুক্তি বাতিল করা হয়েছে এবং এ সংক্রান্ত আরো দুঃসংবাদ তৈরি পোশাক রপ্তানীরকারকদের জন্য অপেক্ষা করছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশেষক্ষেত্রে ছোট আকারের রপ্তানীকারীদের জন্য এ অবস্থার মোকাবেলা করা অত্যন্ত কঠিন। বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যে তৈরি পোশাকখাতসহ অন্যান্য অর্থনৈতিক খাতের জন্য প্রনোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এ বিপর্যয়ের সময় সরকারের এহেন প্রনোদনা অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখবে। তবে তৈরী পোশাক খাতের বিপর্যয় ব্যাংকিং খাতে বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বিশ্ব বানিজ্য পরিস্থিতি এবং তৈরী পোষাক খাতের মন্দা পরিস্থিতি ইতিমধ্যে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে। তৈরী পোষাক খাতের রপ্তানী চুক্তি বাতিলের কারনে এ খাতের উদ্যোক্তারা ব্যাংকগুলোতে তাদের ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণপত্র সংক্রান্তদায় পরিশোধ করতে ব্যর্থ হচ্ছে কিন্তু বাধ্যতামূলকভাবে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে বিদেশী কাচাঁমাল রপ্তানীকারকদের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলে সামনের মাসগুলোতে ব্যাক-টু-ব্যাক ঋণ পত্রের দায় বহন করা ব্যাংকগুলোর জন্য অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। এ পরিস্থিতিতে সামর্থবান অসাধু রপ্তানীকারকরা সুযোগ গ্রহণ করলে তা ব্যাংকগুলোর জন্য আরো ভয়ানক হবে। ঋণপত্রের বিপরীতে আমদানী করে অনেক আমদানীকারক এ সংক্রান্ত ডকুমেন্ট ব্যাংক থেকে গ্রহণ করছে না বা গ্রহণ করতে পারছে না, যা ব্যাংকগুলোর জন্য অনিশ্চয়তা তৈরী করছে। ঋণ পত্রের রীতি অনুযায়ী এ সংক্রান্ত দায় সামনের দিনগুলোতে ব্যাংকগুলোর উপর বর্তাতে পারে। বিশ্ব বানিজ্যে ব্যবহৃত আমদানী/ রপ্তানীর চুক্তিগুলোর আইনি ভিত্তি না থাকা বা দুর্বল হবার কারনে বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের দর কষাকষির সুযোগ কম যা দেশের বৈদেশিক বানিজ্য তথা এ সংক্রান্ত আর্থিক সেবাকে প্রভাবিত করতে পারে মারাত্মক ভাবে। সরকার কর্তৃক প্রদত্ত প্রনোদনা সেক্ষেত্রে ব্যবসায়ী ও ব্যাংকের জন্য স্বস্তির। তবে ব্যাংকের বৈদেশিক বানিজ্য সংক্রান্ত দায় লম্বা সময়ের জন্য সমস্যার কারণ হতে পারে। বিশ্ব ঐতিহ্যের বিপরীতে বাংলাদেশে বৈদেশিক বানিজ্যে মন্দ ঋণ পরিস্থিতি অন্যান্য খাতের তুলনায় কম নয় যদিও ঋণ শ্রেনীবিন্যাসের রীতির আওতায় তা আলাদাভাবে বোঝার উপায় থাকে না। এ পরিস্থিতিতে বৈদেশিক বানিজ্য পরিস্থিতি ব্যাংকগুলোতে মন্দ ঋণের বোঝা অনেক বাড়িয়ে দিতে পারে।
কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে, ঋণপত্র ও চুক্তির আওতায় মূল্য পরিশোধের ক্ষেত্রে কিছু ব্যাংকে অনিয়ম বৃদ্ধি পেতে পারে। পরিস্থিতির সুযোগে তারল্য সংকটে থাকা কিন্তু ব্যাংক বিশ্বব্যাপী মূল্য পরিশোধে দেরী, ঋণপত্রে অযৈাক্তিক ভূল খুঁজে বের করা ইত্যাদি বিষয়ক অনিয়মে জড়ানোর ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাংকগুলোর এধরণের প্রবণতা দেশের কিছু কিছ ব্যাংকেও বিস্তার লাভ করতে পারে যা দীর্ঘকালীণ সুস্থ ব্যাংকিং ব্যবস্থার অন্তরায়।
রপ্তানী বিপর্যয় উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রা সংকট তৈরী হতে পারে। আমদানী পণ্যের মূল্য পরিশোধের জন্য রপ্তানী মূল্য সময়মত পাওয়া জরুরী যা সামনের কয়েকমাস সংকট তৈরী করতে পারে দেশের বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জন্য। এছাড়া কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মধ্যপ্রাচ্য থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসা সংকোচিত বা বন্ধ হলে তা বড় ধরনের চাপ তৈরী করতে পারে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে। এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় নীতি নির্ধারকদের হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হতে পারে।
বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো বৈদেশিক বানিজ্যে আর্থিক সেবা পরিচালনা করে থাকে দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর অওতায়। আন্তর্জাতিক আইন, নীতিমালা ও নির্দেশিকা প্রণয়নে আইসিসি বা ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স এর ভূমিকা সারা বিশ্বে স্বীকৃত। মূলত বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিশ্ব বানিজ্যে আর্থিক সেবার একটি বড় অংশ প্রদান করে এ সংস্থা প্রণীত আইন ও নির্দেশিকার আওতায়। করোনা পরিস্থিতির অনিশ্চয়তার মাঝে বেশ কিছু ক্ষেত্রে আইনী ব্যাখ্যার মতপার্থক্য দেখা দিয়েছে যা নতুন সমস্যা তৈরী করছে।
এ পরিস্থিতিতে অতি সম্প্রতি আইসিসি এ সংক্রান্ত আইনী অবস্থান স্পষ্ট করার চেষ্টা করেছে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও সরকারের জন্য কিছু পরামর্শ প্রদান করেছে। এ সংস্থার আইনী অবস্থান বানিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঋণপত্র ও চুক্তির আওতায় মুল্য পরিশোধে সহায়ক হতে পারে, তবে অনেক জটিল সমস্যার সমাধান নিজেদেরকেই করতে হবে এটা স্পষ্ট। এক্ষেত্রে বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো তাদের সেবা গ্রহণকারী ব্যবসায়ী এবং তাদের বিদেশী কাউন্টার পার্ট বা ব্যবাসায়ীদের সাথে যোগযোগের মাধ্যমে বেশ কিছু সমস্যার সমাধান খুঁজতে হবে। দেশীয় ও বিদেশী ব্যবসায়ীদের স্বদিচ্ছা থাকলে তাদের সক্রিয় সহযোগীতা বানিজ্যিক ব্যাংকগুলো বৈদেশিক বানিজ্য বানিজ্য সংক্রান্ত আর্থিক সেবার জটিলতা থেকে বেড় হতে পারবে নতুবা ব্যাংকগুলোকে বড় দায়ের মুখোমুখী হতে হবে।
করেনা সংক্রান্ত বৈদেশিক বানিজ্যের মূল্য পরিশোধের জন্য আইসিসি প্রদত্ত পরামর্শ বেশ কার্যকর হতে পারে যদি নীতিনির্ধারকরা এ ব্যাপারে কিছু সক্রিয় সিদ্বান্ত গ্রহণ করেন। বিশ্বব্যাপী বিশেষতঃ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে অনলাইনে বানিজ্য সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রেরনের বিপরীতে মূল্য পরিশোধ সংক্রান্ত বাধার অপসারন-একটি স্বল্পকালীন সমাধান হতে পারে। আর দীর্ঘকালীন সমাধান হিসেবে এ সংক্রান্ত সহায়ক আইন প্রনয়ণ ও তার বাস্তবায়ন বিশ্ব বানিজ্যে ব্যাংক অর্থাায়নে একটি বড় ধরনের ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে বলে মনে হয়।
আইসিসি প্রদত্ত আইনের ব্যাখ্যা ও পরামর্শ সমূহ দেশের ব্যাংকার ও নীতি নির্ধারকগন পড়বেন, আলোচনা করবেন ও বিবেচনায় নেবেন-এটাই কাম্য। কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ত এ থেকে পাওয়া যাবে না, তবে আমাদের নিজস্ব সমাধানের পথ খুঁজতে সহায়ক হবে।