পেশাগত নেতৃত্ব ঃ অধিঃনস্তদের সাথে সাফল্য ভাগাভাগি আর দলগত ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণ

April 28, 2020
1639
Views

পেশাগত নেতৃত্ব ঃ অধিঃনস্তদের সাথে সাফল্য ভাগাভাগি আর দলগত ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণ
(বণিক বার্তায় ২০১৮ সালে প্রকাশিত)

-ড. শাহ্ মোঃ আহসান হাবীব

কোন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তার কথা বলছি না, নেতৃত্ব হতে পারে যে কোন পর্যায়ের- যার মাঝে আমরা কিছু মানবীয় গুণাবলী ও সফলতার সমাবেশ দেখতে চাই। প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্বের সাথে পদ মর্যাদা বা ক্ষমতার কোন সম্পর্ক নেই। তবে পেশাগত নেতৃত্বের পর্যালোচনা করতে গেলে পদমর্যাদা, পদের সাথে সম্পৃক্ত পেশাগত দায়িত্ব স্বাভাবিক ভাবেই চলে আসে। পেশাগত নেতৃত্ব একটি প্রতিষ্ঠানের যাবতীয় কার্যক্রমকে প্রভাবিত করে এবং প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের সংকট নিরসনে এবং লোকোবলের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে পেশাগত নেতৃত্বের গুরুত্ব অপরিসীম।

ইংরেজী অভিধানে ‘বস‘ বা ‘লীডার‘ শব্দটিকে একই ভাবে সঙ্গায়িত করা হয়েছে। যা সবার মাঝে ভ্রান্ত ধারণা তৈরী করে। একজন বস বা উর্ধতন কর্মকর্তা যার অধীনে আমি কাজ করি, তিনি একজন যোগ্য নেতা নাও হতে পারেন। তবে তিনি অবশ্যই দায়িত্ব ও ক্ষমতার দিক দিয়ে আমার চেয়ে বড়। পদের দিক থেকে বড় হলেও একজন পেশাদার নেতৃত্ব তাঁর অধীনস্তদের সহযোদ্ধা বা সাথী হিসেবে গণ্য করেন, তাদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করেন, খোলা মনে তাদের ভাল কাজ এর জন্য উৎসাহিত করেন ও প্রশংসা করেন। আর সাথে সাথে দলগত কাজের জন্য অধিকতর দায়িত্ব গ্রহণ ও ব্যর্থতার দায়ভার বহনের মানসিকতা ধারণ করেন।

একথা সত্য যে, আমরা পেশাগত জীবনে নেতৃত্বের থেকে অনুসরণকে বেশী প্রধান্য দেই। প্রতিষ্ঠানের নিয়মের মাঝে চিরাচরিত পন্থা অনুসরণ করে কার্য সম্পাদন করা হবে সেটাই চাই। এহেন অনুসরন নীতি ও পন্থা প্রয়োজনীয়। আমার উর্ধতন কর্মকর্তার দিকনির্দেশনা অনুযায়ী আমি লক্ষ্য অর্জনে সচেষ্ট হব এটাই কাম্য। যা সহজে প্রশংসা পেয়ে থাকে। তবে এটা যথাযত সঙ্গানুসারে নেতৃত্ব নয়। পেশাগত জীবনে আলাদা করে বা নতুন করে ভাবার বা পন্থা বের করার সুযোগ সব সময় থাকে না। তবে সুযোগ অবশ্যই আছে। আর একজন যোগ্য পেশাদার নেতৃত্ব পরবর্তী প্রজন্মের মাঝে তা বিকাশের সুযোগ করে দেন। নেতৃত্ব অনেক সময় উর্ধতন কর্মকর্তার জন্য বিরক্তির কারণ হতে পারে এবং যে কেউ বাঁধার মুখে পড়তে পারেন । কারণ অনেক ক্ষেত্রে নতুন কোনো পন্থা বা কাজের ধরন প্রতিষ্ঠানের স¦াভাবিক কাজকর্মকে তাৎক্ষণিক ভাবে ব্যহত করতে পারে।

পেশাগত নেতৃত্বে সাফল্য অর্জনের জন্য দলগত সাফল্য অত্যন্ত জরুরী। আমার সহকর্মীরা যথাযথ দায়িত্ব পালন করবে এবং পদ মর্যাদা ও অবস্থানে তাদের ক্রমাগত বিকাশ হবে তা স্বাভাবিক। তাদের সফলতায় আনন্দিত হওয়া ও তাদেরকে উৎসাহিত করার মানসিকতা একটি অনন্য ও জরুরী গুণ যা পেশাগত নেতৃত্বের মাঝে অত্যন্ত জরুরী। শুধু মাত্র নিজে নয়, অন্য সহকর্মীরাও একে অপরকে উৎসাহিত করছে কিনা এ ব্যাপারেও দৃষ্টি রাখবে একজন পেশাগত নেতৃত্ব। এ ধরণের পেশাগত সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য অর্জনে বিশেষ সহায়ক যা নিজেদের মাঝে পারষ্পারিক বিশ্বাস ও সম্প্রীতির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সহায়তা করে। প্রতিষ্ঠানের ও অনান্য সামাজিক ও উন্নয়নমূলক কাজে উৎসাহ প্রদান প্রতিষ্ঠানের লোকবলের মাঝে উন্নয়নমুখী দৃষ্টিভঙ্গি আনয়নে সহায়তা করে ।

প্রশংসা একজন কর্মীকে উৎসাহিত ও উদ্যোগী করে। একজন কর্মীর মাঝে এহেন অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাস তাকে অধিকতর কর্মনিষ্ঠ করে, ভাল এবং সার্থক কাজের জন্য যথেষ্ট প্রেষণা প্রদান করে। এ ধরণের প্রশংসা সবার সম্মুখে এবং একান্তভাবে দুক্ষেত্রেই করা প্রয়োজন। অনেকক্ষেত্রে শীর্ষ কর্মকর্তারা সাধারণভাবে এ ধরণের প্রশংসার প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেন। তবে সাধারণভাবে তার বাস্তবায়নের নিদর্শন কম। এক্ষেত্রে সমস্যা হল একজন কর্মী কতটা প্রশংসা আশা করেন আর তাকে কতটা করা হয় তার ব্যবধান। একজন কর্মী হিসেবে আমি নিজেকে প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মী হিসেবে দেখতে চাই। একজন পেশাগত নেতৃত্ব কর্মীদের মাঝে তাদের প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি জাগ্রত করেন এবং উৎসাহিত করার মাধ্যমে যথেষ্ট প্রেষণা প্রদান করেন। এই মোবাইল সংস্কৃতির যুগেও মুখোমুখি প্রশংসা এবং উৎসাহ প্রদানের কার্যকারিতা অসামান্য এবং অতুলনীয়। প্রশংসার ক্ষেত্রে বিষয় চিহ্ণিত করণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একজন দক্ষ কর্মী তার কাজের জন্য প্রশংসার দাবীদার এটা চিহ্ণিত করা সহজ। তবে অনেকের ক্ষেত্রে (যারা অপেক্ষাকৃত কম দক্ষ) তাদের অন্য কোনো সত্যিকারের গুণাগুণের বিচারে প্রশংসার ফলস্বরূপ সুফল পাওয়া সম্ভব যা পেশাগত দক্ষতায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে।
অনেকক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের একটি বিপদজনক দিক হল কর্মীদের মাঝে হিংসা ও বিদ্বেষপূর্ণ মানসিকতা। একজন কর্মীর সফলতা তার সমপর্যায়ের কর্মীদের ঈর্ষার কারণ হলে তা পেশাগত সংস্কৃতিতে আঘাত হানে ও সামগ্রিক সফলতায় বাধা প্রদান করে। শীর্ষ নেতৃত্বের এক্ষেত্রে যথেষ্ট ভূমিকা রাখার অবকাশ রয়েছে। এজন্য পদন্নতি ও যেকোনো প্রনোদনা প্রদানের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ পদ্ধতি অবলম্বন অত্যন্ত জরুরী। একজনকে উৎসাহ প্রদান যেন অন্যের নিরূৎসাহের কারণ না হয়।

সবচেয়ে ভয়ানক ক্ষতিকারক দিক হল অনেক সময় অধিঃস্তনদের সফলতায় একজন উর্ধতন কর্মকর্তা বা বস ঈর্ষান্বিত হয়ে পড়েন। এটি অত্যন্ত অপেশাদার আচরণ যা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর এবং নেতৃত্বের বিকাশে বাঁধা প্রদানকারী। অর্থাৎ এ ধরণের আচরণ প্রতিষ্ঠানের বর্তমান সফলতার ক্ষতি করার সাথে সাথে ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরী তথা সফলতার জন্যও বাঁধা তৈরী করে। অথচ একজন সফল নেতৃত্বের নতুন নেতৃত্ব তৈরীর মাঝেই আনন্দ খোঁজার কথা। আসলে এর মাঝেই তাঁর সত্যিকারের সাফল্য। আমার অনুসরণকারী সঠিক পেশাদার নেতৃত্বে রূপ নেবে, যেদিন সে প্রথাগত পদ্ধতি ভেঙ্গে নতুন পদ্ধতি খুঁজে পাবে আর সে আমার পরিধি ছড়িয়ে নতুন পরিধি তৈরী করবে। অধীন বা অনুসরণকারীর এহেন নেতৃত্বের রূপান্তর একজন পেশাগত নেতৃত্বের সত্যিকারের সাফল্য। আর যদি এ মানসিকতা ধারণ না করি, তাহলে হয়তো আমি বস, কিন্তু নেতৃত্বের গুণাবলী ধারণ করি না।
”নতুনত্ব ”ও ”ভবিষৎ দৃষ্টিভঙ্গি” নেতৃত্ব এবং অনুসরনকারীর মাঝে পার্থক্য গড়ে দেয়। ”অনুসরণ” জরুরী তবে ”নেতৃত্ব” আরো বেশী জরুরী যা কোন প্রতিষ্ঠানের সঠিক ভবিষ্যত কর্মপন্থার নির্দেশনা প্রদান করে। আমার পেশাগত জীবনে যে সমস্ত সমস্যার মুখোমুখী হয়েছি এবং যা প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্ষতিকর ছিল সে ক্ষেত্রগুলোতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার মাঝেই আমার সফলতা । আমার সফলতার জন্য আমি যথাযথ কৃতিত্ব এবং প্রশংসা আশা করব এটাই ষ¦াভাবিক , আর অধিঃনস্তদের সাথে এসব ভাগাভাগি করে নেয়ার মাঝেই প্রকৃত নেতৃত্ব। ব্যর্থতা আসতেই পারে যা হয়ত সামগ্রিক ব্যর্থতা । একজন যোগ্য নেতৃত্ব সে ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণ করে অধিঃনস্তদের মাঝে পরবর্তী কাজের জন্য শিক্ষা নেয়ার সঠিক পরিবেশ তৈরী করেন।
যখন আমি আমার উর্ধতন কর্মকর্তা বা বস এর মাঝে নেতৃত্বের গুণাবলী খুঁজি, তখন নিজেকে প্রশ্ন করি- তিনি কি আমার মাঝে আমার কাজ করার ক্ষমতাকে বের করে আনতে উৎসাহ প্রদান করছেন? তিনি কি সত্যই আমার উন্নতিতে সহায়তা করছেন? তিনি কি আমার উন্নতি ও সাফল্যে সত্যি খুশি হন? তিনি কি দলগত সাফল্যকে সবার মাঝে ভাগ করে দেয়ার মানসিকতা ধারণ করেন? আমার ব্যর্থতার দায়ভার নেয়ার মানসিকতা আছে তার? স্বাভাবিক ভাবে আমার অধিঃনস্তরাও আমার মাঝে এমনটি আশা করেন।

লেখক বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব্ ব্যাংক ম্যানেজমেন্ট (বিআইবিএম) এর অধ্যাপক ও পরিচালক প্রশিক্ষণ হিসেবে কর্মরত আছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *